উদ্বিগ্ন: কাজের খোঁজে গিয়ে তানজানিয়ার জেলে বন্দি স্বামী। চিন্তায় স্ত্রী-পরিজনেরা। হাঁসখালির পশ্চিম হরিণডাঙা গ্রামে। ছবি: প্রণব দেবনাথ।
বিমানবন্দরের সামনে সমানে চিৎকার করে যাচ্ছিলেন এক যুবক— “আমি ইন্ডিয়ায় ফিরব!”
অনেকেই তাঁকে পাগল ভেবে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন। ভাগ্যক্রমে এক ভারতীয়ের সামনে পড়ে যান তিনি। তাঁরই চেষ্টায় টিকিট জোগাড় করে দিল্লির বিমানে ওঠার সুযোগ পান নদিয়ার পাটকেমারির বাসিন্দা হারুন বিশ্বাস। তাঁর বাড়ির লোক এজেন্টের হাতে ফেরার টিকিটের টাকা তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু একটা হাতে লেখা কাগজের টুকরো ধরিয়ে দিয়ে তাঁকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল।
শুধু কি হারুন? বছর কয়েক ধরেই শ্রমিকের কাজ নিয়ে বিদেশে গিয়ে দুর্বিসহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছেন রাজ্যের শয়ে-শয়ে যুবক। প্রতারিত হয়ে ফিরে নদিয়ার রানাঘাটের কাছে ধানতলায় ‘সুরক্ষা মঞ্চ’ গড়েছেন তেমনই কয়েক জন। এজেন্ট মারফত বিদেশে যেতে হলে কোনটা ঠিক রাস্তা আর কোন রাস্তায় যাওয়া মানা, তা তাঁরা চিনিয়ে দিচ্ছেন। সঙ্কটে পড়া পরিবারগুলি যাতে আইন ও প্রশাসনের সহযোগিতা পায়, সেই চেষ্টাও শুরু করেছেন তাঁরা। ইরাকে নিহত সমর টিকাদারের মহখোলার বাড়িতে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের পাশে দেখা গিয়েছিল তাঁদের। হাঁসখালি থেকে তানজানিয়ায় গিয়ে জেলবন্দি আট জনের বাড়িতেও তাঁরা যাচ্ছেন।
শুরুটা হয়েছিল গত ফেব্রুয়ারিতে। ধানতলার বরবেড়িয়া, পূর্ব ন’পাড়া, দৌলা এলাকার জনা আঠারো যুবক মোটা টাকা ঋণ করে এজেন্ট মারফত দুবাই গিয়েছিলেন ফলের সংস্থায় কাজ করবেন বলে। সেখানে তাঁদের দুর্বিসহ অবস্থায় পড়তে হয়। একটা ছোট্ট জায়গায় ৭০ জনের থাকার ব্যবস্থা। এক সঙ্গে সকলের শোয়ার জায়গা হত না, পালা করে ঘুমোতে হত। খাবার দেওয়া হত এক বেলা। বেতন দূরের কথা, মেলেনি কাজও। এরই মধ্যে টুরিস্ট ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে আসে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বাড়ির লোক তাঁদের ফিরিয়ে আনেন।
ফিরে এসে ওই যুবকেরাই তৈরি করেছেন ‘সুরক্ষা মঞ্চ’। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন আরও কিছু প্রতারিত যুবকের আত্মীয়েরা। পাশে রয়েছেন ওই এলাকার কিছু অরাজনৈতিক সমাজসেবীও। ছাপানো হয়েছে লিফলেট। ইতিমধ্যে ৩২টি গ্রামের এক জন করে বিশিষ্ট মানুষকে সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। তাঁদের নেতৃত্বে ওই সব গ্রামে তৈরি করা হয়েছে কমিটি। সচেতনতা শিবির করা হচ্ছে। অন্য নানা গ্রামেও সংগঠন বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। সদস্য বাড়তে-বাড়তে এখন প্রায় তিনশো।
সুরক্ষা মঞ্চের আহ্বায়ক আমিরুল মণ্ডল বলেন, “অনেক কষ্টে ছেলেকে দুবাইয়ে থেকে ফিরিয়েছিলাম। তখনই মনে হয়েছিল, এমন বিপদে যাতে আর কেউ না পড়ে, তার জন্য আমাদেরই সক্রিয় হতে হবে।”
বরবেড়িয়ার সামিম উল হক মণ্ডলও দুবাই থেকে ফিরেছিলেন বহু কষ্টে। তাঁর কথায়, “প্রথমেই বলছি, খুব সাবধানে এজেন্ট নির্বাচন করুন। সুনাম আছে এমন বড় কোনও এজেন্ট ধরুন।” তাঁদের আরও পরামর্শ: প্রতিষ্ঠিত সংস্থার প্রতিনিধিদের কাছে সরাসরি ইন্টারভিউ দিন। আর দিনে ১৮-১৯ ঘণ্টা পরিশ্রম করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করুন।
ভাগ্যান্বেষণে ঘর ছা়ড়তে চাওয়া যুবকদের জন্য ওঁরা লিখছেন নতুন এক বর্ণপরিচয়।