পড়ুয়ার বাড়িতে গিয়ে পড়া বোঝাচ্ছেন সুব্রত মহাপাত্র। নিজস্ব চিত্র
ক্লাসে তো বটেই, ক্লাসের বাইরেও তিনি শিক্ষক।
করোনা বিপর্যয়ে দেশজুড়ে বন্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার আবহে রাখতে ‘বাংলার শিক্ষা’ নামে সরকারি পোর্টালে শ্রেণি-ভিত্তিক ‘মডেল অ্যাক্টিভিটি টাস্ক’ দিচ্ছে শিক্ষা দফতর। ক্লাস নেওয়া হচ্ছে টিভিতেও। কিন্তু রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তিক এলাকার অনেক দরিদ্র ছাত্রছাত্রী তা জানতেও পারছে না। স্মার্ট ফোন হোক বা টিভি—সবই যে তাদের কাছে কষ্ট-কল্পনা। ঝাড়গ্রামের বেলিয়াবেড়া ব্লকের কৃষ্ণচন্দ্র মেমোরিয়াল উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অনেক পড়ুয়াও এই তালিকায় রয়েছে। তবে তাদের মুশকিল আসান হয়েছেন বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক সুব্রত মহাপাত্র।
মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি মেদিনীপুর শহরে। কিন্তু লকডাউনের মধ্যেও ৮০ কিলোমিটার বাইক উজিয়ে বেলিয়াবেড়ায় এসে গ্রামে গ্রামে ঘুরছেন তিনি। অষ্টম শ্রেণির শোভন মাইতি, নবম শ্রেণির প্রিয়া রানা, সত্যানন্দ দে, দশম শ্রেণির পিন্টু দাসেদের বাড়ির উঠোনে বসে পড়া বুঝিয়ে দিচ্ছেন। কৈমা গ্রামের বাসিন্দা নবম শ্রেণির ফুলমণি সরেন বলে, ‘‘বাড়িতে স্মার্ট ফোন, টিভি নেই। সুব্রত স্যরকে ফোন করে বলার পরদিনই তিনি বাইক নিয়ে চলে আসেন।’’ শুধু কি স্কুলের পড়া! চলছে স্বাস্থ্যবিধির পাঠও। কুজড়া গ্রামের বাসিন্দা অষ্টম শ্রেণির রবিন দেহুরি জানায়, মাস্ক না থাকলে মুখে পরিষ্কার রুমাল বা কাপড় বেঁধে রাখতে বলেছেন স্যর। ক’দিন হল দুই জেলার মধ্যে যাতায়াত বন্ধ হওয়ায় আপাতত শিক্ষাবন্ধুদের মাধ্যমে কাজ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন সুব্রত।
আরও পড়ুন: নতুন আক্রান্ত ছয়, ‘লাল’ গণ্ডিতেই আটকে রইল পূর্ব মেদিনীপুর
সুব্রতর এমন কর্মকাণ্ড অবশ্য নতুন নয়। বেলিয়াবেড়ার তিন নাবালিকার বিয়ে আটকেছেন তিনি। অভিভাবকদের দিয়ে আঠারোর আগে বিয়ে না দেওয়ার মুচলেকা লেখা চালু করেছেন। গড়েছেন ‘কন্যাশ্রী ব্রিগেড’। চোলাইয়ের নেশা বন্ধে নিজের টাকায় পাঁচ হাজার পোস্টার ছাপিয়েছেন। মিলেছে স্বীকৃতিও। ২০১৮ সালে কলকাতার একটি সংস্থার তরফে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের হাত থেকে সম্মান পেয়েছেন এই শিক্ষক। আর একটি সংস্থা গত বছর তাঁকে ‘শিক্ষক-রত্ন’ পুরস্কার দিয়েছে। স্কুলের পরিচালন কমিটির সভাপতি বিপদভঞ্জন দে বলছিলেন, ‘‘সুব্রতবাবু আদর্শ শিক্ষক। পড়ানোর পাশাপাশি এলাকায় সামাজিক সচেতনতার কাজেও উনি জড়িয়ে রয়েছেন।’’
মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষা ছড়িয়েছে তাঁর পরিবারেও। মেয়ে শ্রেয়সী এ বার মাধ্যমিক দিয়েছে। ছেলে দেবনীল চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। শ্রেয়সী কন্যাশ্রী প্রকল্পে পাওয়া পুরো টাকাটাই মুখ্যমন্ত্রীর করোনা ত্রাণ তহবিলে দিয়েছে। স্ত্রী সুতপা মহাপাত্রের কথায়, ‘‘স্কুল এবং ওখানকার এলাকা নিয়ে সবসময় ভাবেন উনি। পরিবারের সকলে যাতে সুস্থ থাকে সে দিকে নজর রেখেও নিজের মতো করে করোনা-যুদ্ধে শামিল হয়েছেন।’’ ঝাড়গ্রাম জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (মাধ্যমিক) সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় মানছেন, ‘‘প্রান্তিক-পড়ুয়াদের জন্য সুব্রতবাবুর এই উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।’’
আরও পড়ুন: রোজা শুরুর আগেই ভাগের আলু পৌঁছে দিলেন হোমে
সুব্রতর মুখে শুধুই কর্তব্যের কথা। বলছেন, ‘‘প্রত্যন্ত গ্রামের কয়েকজন পড়ুয়া আমাকে সমস্যা জানিয়েছিল। তাই ওদের বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। একজন শিক্ষক হিসেবে যা কর্তব্য সেটাই করেছি।’’
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)