ওঁদের কেউ এসেছেন মুর্শিদাবাদ থেকে। কেউ এসেছেন বর্ধমান থেকে। এমন বেশ কয়েকজনের দেখা মিলল যাঁরা এসেছেন হুগলি থেকে। তাছাড়া কল্যাণী ও ব্যারাকপুর অঞ্চলের হৃদরোগীরা তো আছেনই। সকলেই পৌঁছে গিয়েছেন সকাল ৮টার আগে। কিন্তু কোথায় কী? কল্যাণী গাঁধী মেমোরিয়াল হাসপাতালে সকাল ১০টা থেকে বহির্বিভাগ শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু চিকিৎসকের ঘর ফাঁকা।
প্রায় দেড় ঘণ্টা এ ভাবে হন্যে হয়ে বসে থাকার পরে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। রোগীর বাড়ির লোকজন বহির্বিভাগ ছেড়ে নিরাপত্তা কর্মীদের পাশ কাটিয়ে চিৎকার করতে করতে জোর করে ঢুকে পড়েন হাসপাতালের মূল ভবনে। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘রোজ রোজ এ ভাবে এসে ফিরব না। যে ভাবেই হোক চিকিৎসককে বসাতেই হবে।’’ কিন্তু কোন চিকিৎসক বসবেন বহির্বিভাগে? কোনও চিকিৎসকই তো নেই তখন।
হাসপাতাল সূত্রের খবর, ওই দিন কয়েক জন চিকিৎসক ছুটি নিয়েছিলেন। বাকিদের ওই সময় ডিউটি ছিল না। কিন্তু রোগী ও তাঁদের আত্মীয়দের চাপে হাসপাতালের লোকজন ফোন করে ডেকে আনেন এক চিকিৎসককে। তারপর শুরু হল রোগী দেখা। কল্যাণী গাঁধী মেমোরিয়াল হাসপাতালে এমন দৃশ্য অবশ্য নতুন নয়।
গত সপ্তাহে রোগী ও তাঁদের পরিজনদের চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে হাসপাতালে ছুটে এসেছিলেন এক চিকিৎসক। কিন্তু চিকিৎসকদেরই একাংশ জানান, হৃদরোগীদের হাসপাতালে যদি পেসমেকার বসানো, ওপেনহার্ট সার্জারিই বন্ধ থাকে তাহলে চিকিৎসা আর কী হবে! শুধু ওষুধ দিয়েই যদি রোগ সারানো যেত তাহলে সাধারণ হাসপাতালই যথেষ্ট ঠছিল। গাঁধী মেমোরিয়ালের মতো বিশেষ হাসপাতালের প্রয়োজন কোথায়?
রোগীদের সুবিধা দেওয়া এবং কলকাতায় ভিড় কমানো, এই দুই কারণে হাসপাতালটি তৈরি করেছিল সরকার। কিন্তু তারপরে ক্রমশ চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে কল্যাণীর গাঁধী মেমোরিয়াল হাসপাতালে। আসলে এই ধরনের হাসপাতালগুলি এখন বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যৌথ ভাবে চালাতে চায় রাজ্য সরকার, এমনটাই অভিযোগ পশ্চিমবঙ্গ হেলথ অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন সভাপতি সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়ের। তাঁর বক্তব্য, ‘‘যে যে হাসপাতালগুলির উৎকর্ষতা ছিল, সেগুলিকে বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কাজ করানোর চক্রান্ত হচ্ছে। যেমন, ঝাড়গ্রাম হাসপাতাল। এটিকেও বেসরকারি সংস্থার কাছে তুলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।’’ তাঁর দাবি, সরকার নিজের হাতে হাসপাতালগুলিকে রেখে অনেক ভাল ভাবে চালাতে পারত।
হাসপাতাল সূত্রে খবর, প্রধানত দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলির হৃদরোগীদের চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে খাতায় কলমে ২৮ জন চিকিৎসক আছেন। আছেন ৮ জন হাউসস্টাফও। ব্যাস, ওইটুকুই! চার বছরেরও বেশি সময় ধরে এই হাসপাতালে হৃদরোগের সব রকম অস্ত্রোপচার বন্ধ। গুরুতর রোগীদের রোজই অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সবকিছু জেনেও সরকারের কোনও হেলদোল নেই। যদিও হাসপাতালের সুপার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ সাউয়ের আশ্বাস, ‘‘আবার নতুন মেশিনপত্র বসানো হচ্ছে। তিন-চার মাসের মধ্যে ফের সব চিকিৎসা ব্যবস্থাই চালু করা যাবে বলে আশা করছি।’’
যদিও সেই আশ্বাসে বিশেষ ভরসা রাখতে পারছেন না অনেকেই। সাড়ে চারশো শয্যার এই হাসপাতালে এমন অবস্থা দেখে বহু চিকিৎসকই বলছেন, যে হাসপাতালে হৃদরোগীদের অস্ত্রোপচারই বন্ধ হয়ে যায়, সেখানে আর হৃদরোগের অন্তঃবিভাগের কী প্রয়োজন? পেসমেকার বসানো থেকে শুরু করে ওপেনহার্ট সব কিছুই যখন বন্ধ এই হাসপাতালে তখন অন্তঃবিভাগ রেখে লক্ষ লক্ষ টাকা নষ্ট করা হচ্ছে কেন?
গাঁধী হাসপাতালকে এমন ঠুঁটো জগন্নাথ করে রাখার পরিপ্রেক্ষিতে চিকিৎসকদের একাংশের বক্তব্য, এই অব্যবস্থা কাটাতে এই হাসপাতালকে সাধারণ হাসপাতাল হিসাবে খুলে দেওয়া হোক। এতে অনেক মানুষ উপকৃত হবেন।