দলের সদর দফতরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি জেটলি। ছবি: পিটিআই।
ঝালমুড়ির ঝাঁঝে এখনও জেরবার বিজেপি। সেই বিড়ম্বনা কাটাতে শনিবার আসরে নামতে হলো নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠতম কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অরুণ জেটলিকেও। এর আগে মোদীর আর এক আস্থাভাজন, বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ যা বলেছিলেন, সেই কথারই কার্য়ত পুনরুক্তি করে জেটলি বললেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির রাজনৈতিক সমঝোতার প্রশ্নই উঠছে না। আমরা তাদের বিরোধী দল। এবং সেই অবস্থাই বজায় থাকবে। কিন্তু তার সঙ্গে রাজ্য-কেন্দ্র সাংবিধানিক সম্পর্ককে জড়িয়ে ফেললে চলবে না। বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্কের থেকে সেটি আলাদা।’’
যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলার কথা গোড়ার দিন থেকেই বলে আসছেন প্রধানমন্ত্রী। আনন্দবাজারকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারেও তিনি বলেছিলেন, রাজ্যগুলির সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতেই সরকার চালাতে চান তিনি। কিন্তু, লোকসভা ভোটের প্রচার পর্বে বিজেপি তথা মোদীর বিরুদ্ধে যে গলা চড়িয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ভোট চুকে যাওয়ার পরেও তার থেকে সরে আসেননি তিনি। মমতা দীর্ঘ ৯ মাস প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ পর্যন্ত না-করায় বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল।
এই পরিস্থিতি পাল্টে যায় সারদা কেলেঙ্কারি মামলা সিবিআইয়ের হাতে যাওয়ার পরে। তৃণমূলের উপরে চাপ বাড়তেই রাষ্ট্রপতি ভবনে মোদীর মুখোমুখি হতে দিল্লিবাসের মেয়াদ বাড়িয়ে নেন মমতা। তার পর ফের দিল্লি গিয়ে একান্তে বৈঠকও করেন মোদীর সঙ্গে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর রাজ্য সফরের সময়েও মোদী-মমতা সৌজন্যের ছবি দেখা গিয়েছে বারবার। এই পর্বেই নজরুল মঞ্চে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠান সেরে রাজভবনে তাঁর সঙ্গে বৈঠক করতে যাওয়ার সময় বাবুল সুপ্রিয়কে নিজের গাড়িতে তুলে নেন মমতা। ভিক্টোরিয়ার সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ভেলপুরি-ঝালমুড়ি খাওয়ান তাঁকে।
বিজেপির কেন্দ্রীয় সূত্র বলছে, কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী হিসেবে বাবুলের মুখ্যমন্ত্রীর গাড়িতে চড়াই উচিত হয়নি। ঝালমুড়ি খাওয়া তো দূরস্থান। বাবুল ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছেন, সৌজন্য বজায় রাখতেই এমনটা করেছেন। কিন্তু বিজেপি নেতাদের অনেকেরই বক্তব্য, রাজনীতিতে অসৌজন্যের কোনও জায়গা নেই ঠিকই। মোদী নিজেও সেই সৌজন্য বজায় রেখে রাজ্যের সঙ্গে সহযোগিতা করার কথা বলেছেন। বাবুলও নবান্ন গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সঙ্গে বৈঠক করতেই পারেন। কিন্তু সে দিন তাঁর উচিত ছিল সৌজন্য বজায় রেখেই মমতার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করা। তা ছাড়া ঝালমুড়ি পর্বের পরে বাবুল আরও মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তা অস্বীকার করার উপায় তো নেই-ই।
কী করেছেন বাবুল? মমতার উপস্থিতিতে কোল ইন্ডিয়ার এক অনুষ্ঠানে আইনস্টাইনের আপেক্ষিতাবাদের নয়া ব্যাখ্যা দেন তিনি। যাকে কার্যত মমতার স্তুতি বলেই মনে করছেন বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বের একাংশ। রূপা গঙ্গোপাধ্যায় তো সরাসরিই এ নিয়ে বাবুলের সমালোচনা করে বলেন, ‘‘বাবুল যখন মুখ্যমন্ত্রী সঙ্গে এক গাড়িতে যান, তাঁর সঙ্গে ঝালমুড়ি খান, তখন তো একটু বলতে পারেন, উনি আমাদের কেন এত মারছেন।’’ বাবুল পাল্টা জবাব দেন, মাঠের লড়াই তিনি মাঠেই লড়ছেন। সৌজন্য আর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফারাক তাঁকে বোঝানোর দরকার নেই।
কিন্তু বাবুলের ব্যাখ্যা সত্ত্বেও বিজেপি-তৃণমূল সম্পর্কে নয়া মোড় ঘিরে জল্পনা প্রবল হয়ে ওঠে। বিরোধীরা বলতে শুরু করেন, পারস্পরিক প্রয়োজন মেটাতেই কাছাকাছি চলে এসেছে দু’টি দল। রাজ্যসভায় সংখ্যালঘু মোদী সরকারের তৃণমূলের সমর্থন দরকার। অন্য দিকে, মমতা চান সিবিআই সারদা তদন্তের ফাঁস আলগা করে তাঁর দলকে স্বস্তি দিন। সেই জন্যই বিমা বিল থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তিতে সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে তৃণমূল। আর সিবিআই-ও সারদা তদন্ত নিয়ে বিশেষ উচ্চবাচ্য করছে না— অভিযোগ বিরোধীদের।
এই ভাবমূর্তি যে পশ্চিমবঙ্গে দলের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় বিরূপ প্রভাব ফেলবে, সেটা আঁচ করেই সক্রিয় হয়ে ওঠেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এমনিতেই লোকসভা ভোট ও তার অব্যবহিত পরে রাজ্যে বিজেপির যে বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল, তা এখন অনেকটাই স্তিমিত হয়ে এসেছে। তখন বহু জায়গাতেই বামেদের পিছনে ফেলে বিরোধী দল হিসেবে এক নম্বরে উঠে এসেছিল বিজেপি। কিন্তু সদ্যসমাপ্ত পুরভোটে পরিস্থিতি পাল্টে গিয়েছে। রাজ্যের প্রায় কোথাওই বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারেনি মোদীর দল। এই পরিস্থিতিতে ‘রাজ্যে কুস্তি আর কেন্দ্রে দোস্তি’র ধারণা যদি মানুষের মনে বাসা বাঁধে, তা হলে এক বছর পরে বিধানসভা ভোটে বিজেপি যে বিশেষ দাগ কাটতে পারবে না, তা বিলক্ষণ বুঝছেন অমিত শাহেরা।
এই কারণেই দু’দিন আগে এবিপি-নিউজ-এর শীর্ষ সম্মেলনে বিজেপি সভাপতি বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে জমি দখলের লড়াই অব্যাহত। এ নিয়ে কোনও সংশয় থাকারও প্রশ্ন নেই।’’ আর শনিবার আরও এক দফা ব্যাখ্যা দিলেন অরুণ জেটলি। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘কেন্দ্র যে ভাবে অন্য এনডিএ বা কংগ্রেস-শাসিত রাজ্যগুলিকে সহযোগিতা করে, পশ্চিমবঙ্গকেও সে ভাবেই সাহায্য করা হবে। এটি একটি সাংবিধানিক দায়। কিন্তু দলগত ভাবে বিজেপি ও তৃণমূল আলাদা।... পুরভোটে নিঃসন্দেহে আমরা ধাক্কা খেয়েছি। তবে রাজ্যে শক্তি আরও বাড়ানোর চেষ্টা আমরা করব।’’
মমতার সঙ্গে তাঁর ‘দহরম মহরম’ যে রাজ্য-কেন্দ্র দু’স্তরেই দলীয় মহলে ভাল বার্তা দেয়নি, সেটা সম্ভবত বুঝেছেন বাবুলও। নিজের মতো করে তা সামাল দেওয়ার চেষ্টাও চালিয়েছেন তিনি। এ দিন বর্ধমানে জেলা মনিটরিং ও ভিজিল্যান্স কমিটির বৈঠকের শুরুতে উপস্থিত অন্য বিধায়ক, সাংসদ, জেলা পরিষদ ও প্রশাসনের কর্তাদের কমিটির চেয়ারম্যান বাবুল রসিকতা করে প্রশ্ন করেন, তাঁরা ঝালমুড়ি খেতে চান কি না। পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘আমি জানি সরকারি কাজ ও রাজনীতির জায়গা আলাদা। ফলে, এ ব্যাপারে কে কী বলল তাতে কিছু যায় আসে না। চাপের মুখে পরিস্থিতি সামাল দিতে আমি বরাবরই দড়। আমাকে এ ব্যাপারে চাপে ফেলা সম্ভব নয়।’’
আর ঝালমুড়ি-সখ্য নিয়ে তৃণমূলের জাতীয় মুখপাত্র ও রাজ্যসভায় দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েনের মন্তব্য, ‘‘সিপিএম, বিজেপি এবং কংগ্রেস তিনটি দলই তৃণমূলের প্রতিপক্ষ। তিন পক্ষের সঙ্গেই আমরা সমান ভাবে লড়াই করছি। কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের মধ্যে সম্পর্ক এর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়।’’