দুই জায়গার মধ্যে দুস্তর দূরত্ব। দু’জায়গার দুই বাসিন্দার নামেও তা-ই। দু’জনের চরিত্রেও বিপুল ফারাক। অথচ আদতে নাকি তাদের মধ্যে কোনও তফাতই নেই!
মধ্যমগ্রামের সাড়া জাগানো জোড়া খুনের তদন্তকে নাটকীয় মোড় দিয়েছে পুলিশের সাম্প্রতিক এই আবিষ্কার। হত্যাকাণ্ডের কায়দা থেকে শুরু করে পদ (প্রদীপ দেব) নামের কুখ্যাত সমাজবিরোধী গ্রেফতার— প্রতি পর্যায়ে হালফিলের মারকাটারি বলিউডি ফিল্মির ছায়া থাকলেও সিনেমাকে হার মানানো আর এক চিত্রনাট্য খাড়া করেছে নতুন তথ্যটি।
কী ভাবে? কার এমন ‘ডবল রোল?’
এক জন নদিয়ার ধুবুলিয়ার সাদামাটা যুবক। সদালাপী, মিশুকে। নাম— সোমনাথ রায়চৌধুরী। এই সে দিন পর্যন্ত ‘মিষ্টি’ স্বভাবের ছেলেটি ধুবুলিয়ায় বাবার ছোট্ট লাইন হোটেল দেখভাল করত। পরে চলে আসে উত্তর ২৪ পরগনার মধ্যমগ্রামে, বাপ-ঠাকুর্দার পৈতৃক বাড়িতে।
আর এক জন হল কলকাতা শহরতলির দাপুটে বাসিন্দা। যাকে বলে গিয়ে ‘রইস’ লোক। বেলঘরিয়া-কামারহাটিতে একাধিক বাড়ি-জমি, হোটেল, বার। গাড়িও একাধিক। নাম— বাবু মণ্ডল। সিন্ডিকেট ব্যবসা থেকে শুরু করে তোলাবাজির বহু অভিযোগ থাকলেও যাকে কেউ ঘাঁটাতে সাহস করে না। যখন যে দল ক্ষমতায়, সেই দলের প্রভাবশালী মন্ত্রীর ঠিক পাশেই তার সদা অবস্থান।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মধ্যমগ্রাম ফ্লাইওভারে জমি-মাফিয়া বাবু সেনকে সঙ্গী সমেত নিকেশ করার ঘটনায় মূল চক্রী হিসেবে বাবু মণ্ডলকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে পুলিশ। শনিবার তার কয়েকটি বাড়ি, হোটেল ‘সিল’ করলেও রবিবার পর্যন্ত অবশ্য তার টিকিও ছোঁয়া যায়নি। কিন্তু বাবু সেন হত্যার তদন্তে নেমে বাবু মণ্ডল সম্পর্কে খোঁজ-খবর করতে গিয়েই পুলিশ জানতে পেরেছে, ধুবুলিয়ার সোমনাথ রায়চৌধুরী আর কামারহাটির বাবু মণ্ডল একই ব্যক্তি।
এ-ও কি সম্ভব?
উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী রবিবার বলেন, ‘‘সোমনাথ রায়চৌধুরীই যে বাবু মণ্ডল, সে ব্যাপারে আমাদের হাতে নিশ্চিত তথ্য এসেছে। তদন্তের স্বার্থে আপাতত এর বেশি বলা যাচ্ছে না।’’
বাবু মণ্ডলের এ হেন দ্বৈত অস্তিত্বের আঁচ মিলেছে স্থানীয় মানুষের মুখেও। মধ্যমগ্রামের উদয়রাজপুরের আদি বাসিন্দা রায়চৌধুরীরা। সেখানে পৈতৃক জমিতে কল্যাণ রায়চৌধুরী ওরফে বাবলুবাবুর বাড়ি। তাঁর একমাত্র সন্তান সোমনাথ ওরফে বাবু। এ দিন গিয়ে দেখা যায়, বাড়ি তালাবন্ধ।। পাশে থাকেন কল্যাণবাবুর ভাই কমল রায়চৌধুরী। পোস্ট অফিসের কর্মী কমলবাবু বলেন, ‘‘দাদা-বৌদি মাঝে মধ্যে ধুবুলিয়া চলে যান। ওখানে ওঁদের লাইন হোটেল। ওঁদের ছেলে সোমনাথ এখন বেলঘরিয়া-কামারহাটির দিকে থাকে। ন’মাসে-ছ মাসে হয়তো মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসে।’’
সোমনাথ নিয়মিত বাড়ি না-এলেও এলাকায় যে প্রায়শ তার পদার্পণ ঘটে, সে ইঙ্গিত পেতে দেরি হয়নি। রায়চৌধুরী বাড়ি ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে সাজানো-গোছানো বড় একটা বাগানবাড়ি, সোমনাথ রায়চৌধুরী-ই যেটির মালিক বলে পাড়া-পড়শির দাবি। ‘‘সোমনাথ আচমকা খুব বড়লোক হয়ে গিয়েছে। রাতে-বিরেতে দলবল নিয়ে এখানে এসে মৌজ-মস্তি করে যায়।’’— বলছেন ওঁরা। এবং বাবু মণ্ডলের ছবি দেখে তাঁদের বিস্ময়োক্তি— ‘‘এ-ই তো সোমনাথ!’’
কেউ কেউ অবশ্য সোমনাথকে বাবু নামেই চেনেন। যশোহর রোডের ধারে বন্ধ একটা বিশাল হোটেল-পানশালা দেখিয়ে তাঁরা বলেছেন, ‘‘এটা আমাদের মধ্যমগ্রামের বাবুর হোটেল। ও এখন কামারহাটিতে থাকে।’’
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর: বাম আমলে কামারহাটি এলাকার এক মন্ত্রীর গায়ে প্রায় সেঁটে থাকত বাবু। জমানা পাল্টালে সে তৃণমূলের মন্ত্রী মদন মিত্রের কাছের লোক হয়ে ওঠে। ভোট-প্রচার থেকে শুরু করে নানা কাজকর্মে তাকে মন্ত্রীর পাশে পাশে দেখা গিয়েছে। এমনকী, মদনবাবুকে যখন আদালতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখনও টিভির পর্দায় তাঁর ঠিক পাশেই বারবার ফুটে উঠেছে বাবুর ছবি। কামারহাটি-বেলঘরিয়ার বহু বাসিন্দার দাবি, শাসকদলের পার্টি অফিসেই বাবুর দেখা পাওয়া যেত নিয়ম করে। যদিও মদনবাবুর এক ঘনিষ্ঠের যুক্তি, ‘‘মন্ত্রীর আশপাশে বহু লোক ঘোরাফেরা করে। এক সঙ্গে ছবিও তোলে। ব্যক্তিজীবনে কে কী করছে, তার বিস্তারিত খোঁজ-খবর রাখা মন্ত্রীর পক্ষে সম্ভব নয়।’’
তা সোমনাথ রায়চৌধুরীকে এ ভাবে ভোল বদলে বাবু মণ্ডল হতে হল কেন?
‘‘রূপান্তরের প্রেক্ষাপট জানতে হলে ফ্ল্যাশব্যাকে বছর পনেরো আগে ফিরে যেতে হবে।’’— মন্তব্য নদিয়া জেলা পুলিশের এক কর্তার। ধুবুলিয়া থানা-সূত্রের ব্যাখ্যা: সেখানে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে সোমনাথদের পারিবারিক যে ধাবা, তার কাছে শ্যামল দে নামে এক ব্যক্তিকে কোপানো হয়েছিল কয়েক বছর আগে। গুরুতর জখম শ্যামলকে সোমনাথই হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতাল তাকে মৃত ঘোষণা করে। তখন অভিযোগ উঠেছিল, সোমনাথই শ্যামলকে কুপিয়ে মারতে চেয়েছিল। লোক জড়ো হয়ে যাওয়ায় সে-ই আবার পরিত্রাতার ভূমিকায় অভিনয় করেছে। এবং হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ায় পথে শ্যামলকে শেষ করে দিয়েছে সে-ই।
ঘটনাটির পরে সোমনাথ ধুবুলিয়ায় যাতায়াত একেবারে কমিয়ে দেয় বলে জানিয়েছেন ওখানকার পুরোনো বাসিন্দারা। এক তদন্তকারীর কথায়, ‘‘আসলে ও তখন মধ্যমগ্রামে এসে বাবু মণ্ডল হয়ে ওঠা শুরু করেছে।’’ কয়েক বছর বাদে কামারহাটিতে গিয়ে রূপ বদল চূড়ান্ত হয়। মধ্যমগ্রামে কেউ তাকে সোমনাথ, কেউ বাবু নামে চিনলেও বেলঘরিয়া-কামারহাটিতে সে হয়ে ওঠে শুধুই বাবু মণ্ডল। ‘বাবুদা।’ যিনি কিনা সব সময়ে ক্ষমতার বৃত্তে। বাম আমলে যেমন মন্ত্রীর ডান হাত, তেমন তৃণমূল জমানাতেও মন্ত্রীর ছায়াসঙ্গী।
বস্তুত জোড়া খুনের এক দিন পরে, গত শুক্রবারও ‘বাবুদা’ আনন্দবাজারের কাছে বুক ঠুকে বলেছেন, ‘‘আমি রাজনীতির লোক। আর যারা (বাবু সেন) খুন হয়েছে, তারা দুষ্কৃতী। ওদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ থাকবে কেন?’’ শুনে বেলঘরিয়াবাসীর প্রতিক্রিয়া, ‘‘বাবুদা বরাবরই খুব রহস্যময়।’’
সন্দেহ নেই, ডবল রোলের সন্ধান বাবু-রহস্যকে আরও ঘনীভূত করেছে।