সেই ওয়ান্ডারার গাড়ি। —নিজস্ব চিত্র
৭৯ বছরের এক প্রবীণ দেহে যৌবন ফেরানোর চেষ্টা করছে দক্ষিণ কলকাতার বসু পরিবার! এ সেই প্রবীণ, যে ৭৫ বছর আগের এক শীত-রাতে ইতিহাসের বাহন হয়েছিল।
প্রবীণের নাম— ওয়ান্ডারার ডব্লু ২৪। ১৯৪১ সালের ১৬ জানুয়ারি রাত দেড়টা নাগাদ যাতে চড়ে এলগিন রোডের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। গাড়িটি তাঁকে গোমো পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসে।
সেই মহানিষ্ক্রমণের ৭৫ বছর পূর্তিতে এ বছর ওই গাড়ি সংস্কার করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো। ঠিক হয়েছে, পুরনো ইঞ্জিন-সহ কোনও অংশই বাতিল করা হবে না। গাড়িটিকে পুরনো চেহারাতেই সংরক্ষণ করা হবে। ব্যুরোর ডিরেক্টর সুগত বসু জানান, জার্মান গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা অডি-র পূর্বসুরি অটো ইউনিয়ন ওই গাড়িটি তৈরি করেছিল। সেই কারণে গাড়িটির সংরক্ষণের জন্য অডির সঙ্গেই চুক্তি করেছেন তাঁরা। অডির তরফে ওই গাড়ির রেস্টোরেশনের দায়িত্ব পেয়েছেন কলকাতার হরিশ মুখার্জি রোডের বাসিন্দা, ভিন্টেজ গাড়ি বিশেষজ্ঞ পল্লব রায়। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে সংরক্ষণের কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে অডিকে। সুগতবাবুর কথায়, ‘‘আমরা চাই, ওই গাড়ি পুরনো ইঞ্জিনেই ফের চলৎশক্তি ফিরে পাক। বাস্তবে সেটা সম্ভব কি না, আমরা জানি না। ডিসেম্বরে অডি-র কাজ শেষ হলে বোঝা যাবে, আমাদের ইচ্ছে পূরণ হল কি না। তবে অপটিকাল রেস্টোরেশন হবেই। অর্থাৎ, গাড়ির সব পুরনো অংশ সারিয়ে পুরনো চেহারাতেই ফিরিয়ে দেওয়া হবে।’’
১৯৪০ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রেসিডেন্সি জেল থেকে ছাড়া পেয়ে এলগিন রোডের বাড়িতে যান সুভাষচন্দ্র। সেখানে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নজরবন্দি করে রাখে। সেই সময় বাড়ি থেকে পালানোর জন্য ভাইপো, প্রখ্যাত চিকিৎসক শিশিরকুমার বসুর সাহায্য চান তিনি। শিশিরবাবুরই পুত্র সুগতবাবু। তিনি বলেন, ‘‘সেই সময় দু’টো গাড়ি নিয়ে আলোচনা হয়। একটা আমার ঠাকুরদা শরৎ বসুর স্টুডি বেকার প্রেসিডেন্ট গাড়ি। অন্যটি আমার বাবার ওয়ান্ডারার। ঠাকুরদার গাড়িটা যেহেতু শরৎ বসুর গাড়ি হিসেবে সকলে চিনত, তাই ওটায় চড়ে পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে চলে যাওয়া কঠিন ছিল। তাই শেষ পর্যন্ত ওয়ান্ডারার গাড়িটায় চড়েই মহানিষ্ক্রমণ করেন তিনি।’’ সুগতবাবুর সংযোজন, ‘‘সুভাষচন্দ্র থেকে নেতাজি হয়ে ওঠার পথে ওই গাড়ি একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল।’’
মহানিষ্ক্রমণের পথ।
শিশিরবাবুর নামে ওই ওয়ান্ডারার গাড়ির রেজিস্ট্রেশন হয় ১৯৩৭ সালে। তিনি নিজেই ওই গাড়ি চালাতেন। ১৯৪১ সালের ১৬ জানুয়ারি তিনিই চার দরজার গাড়িটি নিয়ে বাড়ির পিছনের সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মহম্মদ জিয়াউদ্দিনের ছদ্মবেশে সেখানে এসে ওঠেন সুভাষচন্দ্র। গাড়ি রওনা হয়। প্রথমে একটু দক্ষিণমুখী গাড়ি চালান শিশিরবাবু। অ্যালেনবি রোড ঘুরে আবার একটু উত্তরে সরে আজকের শরৎ বসু রোড হয়ে শিয়ালদহ, হ্যারিসন রোড (এখনকার মহাত্মা গাঁধী রোড) হয়ে হাওড়া হয়ে গোমো পৌঁছন তাঁরা। সুভাষচন্দ্রকে সেখানে নামিয়ে দিয়ে শিশিরবাবু কলকাতায় ফিরে আসেন। তার পর ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত নিয়মিত শিশিরবাবু এবং তাঁর পরিজন-বন্ধুদের নিয়ে ভ্রমণ করেছে ইতিহাসের সাক্ষী ওই ওয়ান্ডারার। ১৯৫৫ সালে শিশিরবাবুর বিয়ে হয়। তাঁর স্ত্রী কৃষ্ণা বসু এবং সুগতবাবুও ওই গাড়ি চড়েছেন। ১৯৫৭ সালে নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো গড়ে তোলার পরে নেতাজি সংগ্রহশালায় প্রথম যে বস্তুটি শিশিরবাবু প্রদর্শনের জন্য দিয়ে দেন, সেটি ওই ওয়ান্ডারার। ১৯৭৯ সালে নেতাজিকে নিয়ে একটি জাপানি ছবির শ্যুটিংয়ে গাড়িটি শেষ বারের মতো চালিয়েছিলেন তিনি।
সুগতবাবু বলেন, ‘‘আগামী বছর স্বাধীনতার ৭০ বছর, ওই গাড়ির ৮০ বছর এবং নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোর ৬০ বছর হবে। তাই আমরা চাইছি, আগামী বছরই গাড়িটি তার পুরনো চেহারায় ফিরে আসুক। সে ক্ষেত্রে নেতাজির মহানিষ্ক্রমণের দিনকে মনে রেখে আগামী ১৬ বা ১৭ জানুয়ারি— গাড়িটি প্রদর্শনের চেষ্টা হবে।’’