অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।
মেদিনীপুর শহর থেকে ভাদুতলা হয়ে পিচ রাস্তাটা সোজা চলে গিয়েছে লালগড়। ভীমপুর পেরিয়েই বাঁ দিকে ঢুকে গিয়েছে রাস্তাটা। সেটা ধরে প্রায় ৮ কিলোমিটার গেলেই একের পর এক গ্রাম— করমশোল, রাওতাড়া, তাড়কি, জঙ্গলখাস...
এই রাস্তাটাই বেশ কয়েক বছর আগে ছিল মোরামের। প্রতি পদে পোঁতা থাকত ল্যান্ডমাইন। মাওবাদী নেতা কিষেনজির একেবারে খাসতালুক। কিন্তু, এখন একেবারে বদলে গিয়েছে। চার দিকে উন্নয়নের ছোঁয়া। যে পাকা রাস্তাটা ধরে এলাম, সেটাও এই তৃণমূল সরকারের আমলে তৈরি।
কিন্তু, গ্রামগুলোতে ঢুকে দেখা গেল উন্নয়ন আসলে বাইরেই হয়েছে। ভিতরে তার কোনও প্রতিফলন নেই। যার জেরে পূর্ণাপানি গ্রাম সংসদের জঙ্গলখাস গ্রামেই পর পর শবর সম্প্রদায়ের সাত জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে এক জন মহিলা।
ওই পিচ রাস্তার উপরেই জঙ্গলখাস গ্রাম। প্রায় ৩৫ ঘর শবরের বাস এখানে। গ্রামের শেষ প্রান্তে মাঠের ধার ঘেঁষে একটা ঘর। ঘর বলা ভুল। চারটে দেওয়ালের মধ্যে দুটো মাটির, তা-ও কোমর সমান উঁচু। বাকি দুটো দেওয়াল শালপাতা দিয়ে ঘেরা!
সেই ঘরের সামনেই দেখা হল বছর ষাটেকের চুনু শবরের সঙ্গে। ঘোলাটে চোখ। গত শনিবার তাঁর ২৮ বছরের ছেলে মঙ্গল মারা গিয়েছে। ছেলের কী হয়েছিল? জিজ্ঞাসা করাতে চুনু বললেন, ‘‘মংলু বেশ কয়েক মাস ধরে টিবিতে ভুগছিল। তাড়কিতে ডাক্তার দেখিয়েছিল। ওষুধ খাচ্ছিল। শনিবার হঠাৎ করেই মারা গেল।’’ মঙ্গলের মতো এই গ্রামেই চলতি মাসে মারা গিয়েছেন তিন জন। তার আগের কয়েক সপ্তাহে আরও তিন জন মারা গিয়েছেন।
তাঁদেরই এক জন সুধীর শবর (৬৩)। মঙ্গলবার সুধীরের পুত্রবধূ রেবতী বললেন, ‘‘বেশ কিছু দিন ধরেই ওঁর পেট, পা ফুলে যাচ্ছিল। লালগড়ের হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়েছিল। ওরা ভর্তি নিতে চায়নি। ওষুধ দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। তাতে কমেনি। গ্রামে যে ডাক্তারবাবু আসেন, তাঁকেও এক বার ২০০ টাকা দিয়ে দেখিয়েছিলাম। তার পরেও কমেনি।’’ এ মাসের ৭ তারিখে সুধীর মারা যান।
করমশোল গ্রামে ভেঙে যাওয়া বাড়ির সামনে তাঁবুতে বাস করছেন শ্রীনাথ শবর। নিজস্ব চিত্র।
দীর্ঘ দিন ধরে শবর সম্প্রদায়ের উপর এই এলাকায় কাজ করছে একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তেমনই একটি সংস্থার কর্মী অরূপ মুখোপাধ্যায়। পুরুলিয়ায় শবর আশ্রমও চালান তিনি। তাঁর মতে, একই গ্রামে একসঙ্গে এত মানুষের মৃত্যুর একমাত্র কারণ অপুষ্টি। অরূপবাবুর কথায়, ‘‘পুরুলিয়া, বাঁকুড়া বা ঝাড়গ্রামে শবরদের মধ্যে টিবি, হাত-পা-পেট ফুলে যাওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। এগুলো মূলত অপুষ্টির কারণেই হয়। কাজ করতে গিয়ে সেটাই বুঝেছি।’’
শ্রীনাথ শবরের তাঁবুতে তাঁর ছেলে নয়ন শবর। নিজস্ব চিত্র।
যদিও প্রশাসন এই অপুষ্টির কথা উড়িয়ে দিয়েছে। ঝাড়গ্রামের জেলাশাসক আয়েশা রানি শবরদের জীবনযাপনকেই এ জন্য দায়ী করছেন। তিনি বললেন, ‘‘যাঁরা মারা গিয়েছেন, তাদের বেশির ভাগেরই টিবি হয়েছিল। লিভারেও সমস্যা ছিল কয়েক জনের। কিন্তু, অপুষ্টির কোনও ঘটনা ঘটেনি। তা ছাড়া ওঁরা নিয়মিত চিকিৎসাও করান না। মদ্যপানও করেন। এ সবই কারণ। অপুষ্টি কোনও ভাবেই নয়।’’
কিন্তু, গ্রাম ঘুরে জানা গেল এই শবর পরিবারগুলির অর্ধেক দিন খাওয়াই হয় না। সরকার দু’টাকা কেজি দরে চাল দেয় বটে, কিন্তু সেটাও এই পরিবারগুলোর জন্য অপর্যাপ্ত। জঙ্গলখাস গ্রামেই বাড়ি মামণি শবরের। সব মিলিয়ে ১১ জনের পরিবার। কিন্তু, রোজগার করা মানুষ বলতে তাঁর স্বামী এবং দেওর। দু’টাকা দরে রেশনের চাল তাঁরা পান। কিন্তু, সেটা সপ্তাহে মোটে সাড়ে ১১ কেজি। তার পরেও প্রত্যেক সপ্তাহে ১২ থেকে ১৫ কেজি চাল খোলা বাজারে ২০ টাকা কেজি দরে কিনতে হয়। অনেকের আবার রেশন কার্ডও নেই। অতুল শবরের কথায়, ‘‘কী করে থাকবে বলুন তো! আমাদের তো বাড়িতেই বাচ্চাকাচ্চা হয়।’’
আরও পড়ুন: মৃত্যুর হাহাকার নেই, জীবিত শবরপল্লির চিন্তা শুধু দু’মুঠো ভাত
ওই পরিবারের দৈনিক রোজগার কত? মামণি বললেন, ‘‘কাজ পেলে দুই ভাইয়ের রোজগার সব মিলিয়ে ২০০ টাকা। সরকার যা দেয় তাতে চলে না। আর শুধু তো চাল নয়, তার সঙ্গে অন্যান্য জিনিসপত্রও তো কিনতে হয়! আমাদের টাকা কোথায় সে সব কেনার?’’
শবরদের খাদ্যাভাস অনুযায়ী, তাঁরা দিনে তিন বার ভাত খান। সঙ্গে সব্জি। মাছ হয় না বললেই চলে। কখনও সখনও একটু মুরগির মাংস। কিন্তু টাকা না থাকলে সে সব কিনবেন কোথা থেকে? রোজগারই তো নেই! গ্রামেই ঘর অতুল শবরের। স্ত্রী চমলা, মা তিতা, আর তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার। চমলা বললেন, ‘‘ভাল সময়ে সপ্তাহে এক দিন, বড় জোর দু’দিন ৩০০ গ্রাম মুরগির মাংস কিনতে পারি। কিন্তু, বছরের বেশির ভাগ সময়টাই তো খারাপ থাকি। কাজ থাকে না।’’
কী করেন এই শবর পরিবারের মানুষ জন?
আরও পড়ুন: একই গ্রামে ৭ শবরের মৃত্যু লালগড়ে, জানলই না প্রশাসন!
গ্রাম ঘুরে যা জানা গেল, এরা মূলত জঙ্গলের জমি বা সরকারের খাস জমিতে বাস করেন। ভিটেটুকু ছাড়া আর কোনও জমি নেই। এক কালে জীবিকা ছিল শিকার। এখন জঙ্গল থেকে হয় কাঠ কেটে বিক্রি করা, নয়তো অন্য চাষির বাড়িতে মজুর খেটে এদের দিন গুজরান হয়। যাঁরা মারা গিয়েছেন, তাঁরা মূলত এই দিনমজুরের কাজই করতেন। দিন গেলে রোজগার ১০০ থেকে ১২০ টাকা। তা-ও মাসে বড় জোর ১৫ দিন। বাকি ক’দিন কোনও রোজগারই নেই। এখন কার্তিক মাস, ধান উঠে গিয়েছে। ফলে, কোথাও আর কৃষি শ্রমিকের কাজ নেই। অর্থাৎ সকলেই কার্যত বেকার! বিনপুর ১ ব্লকের এনআরইজিএ-র নোডাল অফিসার জাহির আব্বাসও স্বীকার করে নিয়ে বললেন, ‘‘রেশন ব্যবস্থায় দু’টাকা কেজি দরে ওঁরা যে চাল পান, সেটা পর্যাপ্ত নয়।’’ বিনপুর ১ নম্বর ব্লকের বিডিও এফ আসরফ দাবি করেন যে, দু’টাকা কিলোয় চাল দেওয়ার পাশাপাশি ত্রাণের চাল দেওয়া হয় বিনা পয়সায়। কিন্তু, গ্রামবাসীরা জানাচ্ছেন, দু’টাকা কেজি চালের বাইরে তারা কখনও কোনও চাল পাননি।
জঙ্গল খাস গ্রামে শনিবার মৃত মংলু শবরের বাবা চুনু শবর। নিজস্ব চিত্র।
কিন্তু, একশো দিনের কাজ রয়েছে তো। সে সব কাজ পান না?
অরূপ মুখোপাধ্যায় যেমন জানালেন, শবর জনজাতির জীবনযাপনটাই আলাদা। ওরা জীবনে সঞ্চয় করে না। বছরের এক একটা বড় সময় থাকে, যখন এক কেজি চাল কেনার ক্ষমতাও থাকে না। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রামের বহু জায়গায় এরা ১০০ দিনের কাজও পায় না বলে অভিযোগ তাঁর।
আরও পড়ুন: ‘স্বনামধন্য সংগঠক’ বলে খোঁচা, রথযাত্রার প্রস্তুতি বৈঠকে বিজেপির কোন্দল ফের প্রকাশ্যে
কথাটা মেনেই নিলেন স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য বাসন্তী মাহাতো। তাঁর স্বামী বিমলই বকলমে দায়িত্ব সামলান। স্ত্রী পাশে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, ‘‘এই গ্রামগুলোয় যে শবররা বাস করেন, তাঁরা খুব বেশি হলে ১০০ দিনের কাজে ৫০ দিন কাজ পেয়েছেন। বাকি দিন কাজ দেওয়া সম্ভব হয়নি।’’
কয়েক দিন আগেই মারা গিয়েছেন বছর চৌত্রিশের কিসান শবর। তাঁর ভাই গৌতম জানালেন, দাদা এক বছর ধরে টিবিতে ভুগছিল। ওযুধ খেতেন না তেমন নিয়ম করে। কারণ ওষুধ কেনার টাকা ছিল না। গৌতমের কথায়, ‘‘কাজ না থাকলে টাকা আসবে কী করে! টাকা না আসলে খাবার নেই। আর আমরা শব্বররা খাটালে বাঁচি। ভাত না পেলে খাটব কী করে?’’
আরও পড়ুন: ফের বিতর্কিত ভিডিয়ো, ঋতব্রতর পরে শাস্তির মুখে সিপিএমের দুই যুব নেতা
শুধু খাবার নয়, উন্নয়নের কোনও ছোঁয়াই পড়েনি এঁদের বাসস্থানে। শ্রীনাথ শবরের বাড়ি করমশোল গ্রামে। পূর্ণাপানি মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রের পাশে। গত বর্ষায় বাড়ি বসে গিয়েছে। তার পর থেকে একটা কালো ত্রিপলের তলায় তাঁবু খাটিয়ে স্ত্রী বদন এবং দুই ছেলেকে নিয়ে বসবাস করছেন। বাড়ির জন্য বলেছেন? জবাব এল, ‘‘এক বার বলেছি। তার পর আর যাইনি। বাড়ির কথা বললেই তো টাকা চাইবে।’’
জেলাশাসক আয়েশা রানি শবর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলছেন। নিজস্ব চিত্র।
শ্রীনাথের কথার হাতেনাতে প্রমাণ মিলল। ওঁর বাড়ি থেকে দু’পা এগোলেই কার্তিক শবরের বাড়ি। ২০১৪-১৫ বাড়ির জন্য ইন্দিরা আবাস যোজনায় ৭৫ হাজার টাকা পেয়েছেন। প্রথম দফার ১৮ হাজার টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তোলার সময় তিন হাজার টাকা তৃণমূলের পার্টি তহবিলে দিতে হয়েছে। কার্তিকের দাবি, ‘‘আমাদের গ্রামে যারা টাকা পেয়েছে, প্রত্যেককেই টাকা দিতে হয়েছে দলকে।’’
অথচ উন্নয়ন দেখলে চোখে ধাঁধাঁ লেগে যাবে। যেমন গ্রামে প্রচুর টিউবওয়েল পোঁতা হয়েছে। কিন্তু, শবররা এখনও কুয়ো থেকে জল তুলে খান। কারণ, সব টিউবওয়েলই খারাপ হয়ে গিয়েছে। পূর্ণাপানি মাধ্যমিক কেন্দ্রের সামনে একটা পাম্প দিয়ে জল তোলার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সেটা স্কুল খোলা থাকলে, শিক্ষকরা এলেই খোলা থাকে। বাকি সময় বন্ধ।
উন্নয়নের এই জোয়ারে কেন শবরদের কোনও উন্নতি হচ্ছে না?
আরও পড়ুন: সেরার দৌড়ে পশ্চিমবঙ্গ, ছুটিতে ধারেকাছে নেই প্রায় কেউই!
তৃণমূল কংগ্রেসের বিনপুর ১ নম্বর ব্লকের সভাপতি শ্যামল মাহাতো বললেন, ‘‘দেখুন শবররা আসলে নিজেদের দাবিদাওয়াগুলো নিয়ে সরব হতে পারে না। আমাদেরই দায়িত্ব নিয়ে ওদের কাছে পৌঁছতে হবে। সরকারি প্রকল্পের সুবিধা ওদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।’’
সাত জনের মৃত্যুর খবর প্রকাশ্যে আসতেই নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। এখন গ্রামে খাবার পাঠানো হচ্ছে। খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। জল পাঠানো হচ্ছে। জামাকাপড় দেওয়া হচ্ছে। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিরা আসছেন। তিন জনকে ভর্তি করা হয়েছে হাসপাতালে।
আসলে ঘুমটা হয়তো ভাঙল! কিন্তু, কবে? সাত শবরের মৃত্যুর পরে।
(পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার খবর এবং বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাংলায় খবর পেতে চোখ রাখুন আমাদের রাজ্য বিভাগে।)