পূর্বাঞ্চলে প্রথম হাত প্রতিস্থাপনের সাক্ষী থাকল কলকাতা। —ফাইল চিত্র।
সম্মতি দিয়েও, পরক্ষণেই আবার না বলে দিচ্ছিলেন পরিজন। তিন-চার বার এমন হওয়ার পরে, সিদ্ধান্তে অনড় থাকলেন মৃতের স্ত্রী। আর তার ফলে পূর্বাঞ্চলে প্রথম হাত প্রতিস্থাপনের সাক্ষী থাকল কলকাতা।
শনিবার উলুবেড়িয়ার বাসিন্দা তেতাল্লিশ বছরের যুবকের দু’টি হাত প্রতিস্থাপন করা হল এসএসকেএমে চিকিৎসাধীন সাতাশ বছরের আর এক যুবকের শরীরে। মরণোত্তর অঙ্গদানে হৃৎপিণ্ড, কিডনি, যকৃৎ, ফুসফুস প্রতিস্থাপনের কথা শোনা গেলেও, ‘ব্রেন ডেথ’ হওয়া রোগীর হাত অন্যের শরীরে প্রতিস্থাপন করার কথা সচরাচর শোনা যায় না। বিশ্বে এখনও পর্যন্ত এর সংখ্যা ১১০টির মতো। দেশে সেই সংখ্যা ১৫। তাতে নাম জুড়ল এ রাজ্যের সরকারি হাসপাতালের। এ দিন সকাল ৬টা থেকে শুরু হয়ে রাত পর্যন্ত চলেছে প্রতিস্থাপন। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, খুবই ভাল উদ্যোগ। কিন্তু প্রতিস্থাপন করা হয়ে যাওয়া মানেই সেটি ১০০ শতাংশ সার্থক তা বলা যাবে না। কারণ, অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ঘটনায় অনাক্রম্যতার কারণে প্রত্যাখ্যানের হার কিডনির ক্ষেত্রে যেখানে ১০ শতাংশ, হাতের ক্ষেত্রে সেটি ৮৬ শতাংশ। তাই প্রতিস্থানের পরে প্রথম কয়েকটি দিন খুবই কড়া পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে রোগীকে। তারপরে আরও এক বছর নজরদারিতেই থাকতে হবে।
জানা যাচ্ছে, গত ৯ জুলাই সন্ধ্যায় রাস্তা পার হওয়ার সময় গাড়ির ধাক্কায় ছিটকে যান উলুবেড়িয়ার রাজপুর করাতবেরিয়ার বাসিন্দা হরিপদ রানা। তাঁকে উলুবেড়িয়া মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও সেখান থেকে এসএসকেএমের ট্রমা কেয়ারে স্থানান্তরিত করা হয়। দুর্ঘটনার পর থেকেই অচৈতন্য ছিলেন ওই যুবক। হাসপাতাল সূত্রের খবর, ১৩ জুলাই রাতে বোঝা যায় হরিপদর ‘ব্রেন ডেথ’ হচ্ছে। সেই অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরে তাঁর পরিজনকে কমরণোত্তর অঙ্গদান সম্পর্কে বোঝাতে শুরু করেন চিকিৎসকেরা। জানা যাচ্ছে, হরিপদর রক্তের গ্রুপের সঙ্গে পিজির প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে প্রায় এক বছর ধরে চিকিৎসাধীন যুবকের মিল পাওয়া যায়। তখনই হাত দান করার গুরুত্বও বোঝানো হয় পরিজনকে। তাঁর ভাইপো দেবকুমার বলেন, ‘‘আমরাও ভেবে দেখলাম এমনিতেই কাকার দেহের ময়নাতদন্ত হবে। সেখানে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও হাত যদি অন্য রোগীদের স্বাভাবিক জীবন দান করে, ভালই হবে। কাকিমা প্রথম থেকেই বিষয়টিতে রাজি ছিলেন।’’
সূত্রের খবর, বছর খানেক আগে বৈদ্যুতিক শকে ঝলসে গিয়েছিলেন বিরাটির বাসিন্দা ওই গ্রহীতা। তাঁর ডান হাতের কনুইয়ের নীচ থেকে বাদ দিতে হয়েছিল। ভবিষ্যতে প্রতিস্থাপনের কথা ভেবে তখনই শিরা, ধমনী, স্নায়ু ও টেন্ডন (শক্ত ও মোটা তন্তু)-কে ঠিক রেখে কোমর থেকে মাংস নিয়ে তা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। ওই যুবকের বাঁ হাত থাকলেও, সেটি পুরো অসাড় হয়ে গিয়েছিল। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, প্রায় এক বছর ধরে বিভিন্ন পরীক্ষা, টিকা দিয়ে ওই যুবককে প্রতিস্থাপনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। মেডিক্যাল বোর্ডের ছাড়পত্রও নেওয়া হয়েছিল। এর পরে ‘রিজিওনাল অর্গান অ্যান্ড টিসু ট্রান্সপ্লান্ট অর্গানাইজেশন (রোটো)’-এ নাম নথিভুক্ত করা হয়। শুক্রবারই বিরাটির ওই যুবককে পিজির প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে ভর্তি করা হয়।
জানা যাচ্ছে, এর আগে ‘ব্রেন ডেথ’ হওয়া এক ব্যক্তির পরিজন প্রথমে রাজি হলেও, পরবর্তী সময়ে হাত দানে সম্মতি দেননি। ২০২১ সালে হাত প্রতিস্থাপনের ছাড়পত্র পেয়েছে এসএসকেএম। তার পরে এই প্রথম হচ্ছে প্রতিস্থাপন। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, মরণোত্তর অঙ্গদানের ক্ষেত্রে প্রথমে ‘ব্রেন ডেথ’ হওয়া রোগীর হৃৎপিণ্ড আহরণ (রিট্রিভাল) করা হয়। কিন্তু রোগীর পরিজন হাতের ক্ষেত্রেও অনুমতি দিলে প্রথমে সেটি ‘রিট্রিভাল’ করতে হয়। সেই মতো এ দিন ভোর ৫টা থেকে সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়। হরিপদর দু’টি হাতই কনুইয়ের কিছুটা উপর থেকে কেটে নেওয়া হয়। বদলে সেই জায়গায় নকল হাত লাগানো হয়েছে। ট্রমা কেয়ার থেকে হাত দু’টি রোনাল্ড রস বিল্ডিংয়ের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের অপারেশন থিয়েটারে এনে প্লাস্টিক সার্জারি, অর্থোপেডিক, নেফ্রোলজি বিভাগের চিকিৎসকদের দল প্রতিস্থাপনে অংশ নেন। হরিপদর হৃৎপিণ্ড পেয়েছেন নারায়ণ সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের ৫৭
বছরের প্রৌঢ়, দু’টি কিডনি ও যকৃৎ পেয়েছে এসএসকেএম। সেগুলিও এ দিন প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।