মানবাধিকার কমিশনের ‘ভোট পরবর্তী হিংসা’-র রিপোর্ট।
রাজ্যে আইনের শাসন নেই, শাসকের শাসন চলছে। ‘ভোট পরবর্তী হিংসা’-র রিপোর্টে বাংলার রাজ্য সরকারকে ঠিক এই ভাষাতেই তুলোধনা করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। শুধু তাই নয়, রিপোর্টে কবিগুরুর ‘চিত্ত যেথা ভয় শূন্য’ কবিতার পংক্তি উদ্ধৃত করে লেখা হয়েছে, ‘যে মাটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম, সেই মাটিতে হাজার হাজার মানুষের উপর এই রকম নৃশংস অত্যাচার, খুন, ধর্ষণের ঘটনা অকল্পনীয়।’ রিপোর্টে সেই সব ঘটনায় সিবিআই তদন্তের দাবি তুলে মামলা বাইরের রাজ্যে স্থানান্তরের পক্ষে সওয়াল করেছে কমিশন।
মঙ্গলবার ‘ভোট পরবর্তী হিংসা’ মামলার শুনানিতে পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চের কাছে ‘মুখবন্ধ’ খামে এই রিপোর্ট জমা দিয়েছিল কমিশন। তার পর রাজ্যের আবেদন মেনেই বৃহস্পতিবার এই রিপোর্ট প্রকাশ্যে আনা হল। তাতে লেখা হয়েছে, ‘শাসক দলের কর্মী-সমর্থকরা রাজ্যে যে ভাবে হিংসার বাতাবরণ তৈরি করেছে, তাতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়েছে। হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকায় তার প্রভাব পড়েছে। শাসক দলের দুষ্কৃতীদের আতঙ্কে বহু মানুষ এখনও ঘর ছাড়া। যৌন অপরাধের শিকার হয়েছে বহু মানুষ, কিন্তু তাঁরা মুখ খুলতে পারছেন না ভয়ে।’ স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে লেখা হয়েছে, ‘হিংসার ঘটনায় পুলিশ সরাসরি ভাবে যুক্ত না থাকলেও তাদের গাফিলতিতে অনেক ঘটনা ঘটেছে।’
উদ্বেগ প্রকাশ করে রিপোর্টে কমিশন লিখেছে, ‘হিংসার ঘটনা নিয়ে রাজ্যের কোনও প্রশাসনিক কর্তা বা রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের মুখ খুলতে দেখা যায়নি। দিনের পর দিন সাধারণ মানুষের জীবনের অধিকার, বাক্স্বাধীনতার মতো মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলেও রাজ্য প্রশাসনকে এই বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে দেখা যায়নি। রাজ্য জু়ড়ে যে হিংসার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তার পিছনে রাজনীতি, আমলাতন্ত্র এবং অপরাধ জগতের আঁতাঁত রয়েছে।’
আইনের শাসন, রাজনীতির বহুত্ববাদ, স্বচ্ছ নির্বাচনের মতো গণতন্ত্রের একাধিক স্তম্ভকে নাড়িয়ে দিয়েছে সেই সব ঘটনা, এমনটাই মনে করছে কমিশন। ভোট পরবর্তী পরিস্থিতিতে রাজ্যে খুন, ধর্ষণের মতো যে সব ঘটনা ঘটেছে, তার তদন্তভার কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছে কমিশন। পাশাপাশি ওই সব মামলা শুনানি অন্য রাজ্যেই হওয়া উচিত বলে মনে করছে কমিশন।
রিপোর্টে কমিশনের সুপারিশ, মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ফাস্ট ট্র্যাক আদালত গঠন করা প্রয়োজন। স্বচ্ছ তদন্তের স্বার্থে সিট গঠন এবং মামলার সাক্ষীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা বিশেষ ভাবে জরুরি। বিশেষ সরকারি আইনজীবীদের নিযুক্ত করার পক্ষেও সওয়াল করেছে কমিশন। এছাড়াও হিংসার ঘটনার শিকার হয়েছেন যাঁরা, তাঁদের ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসন এবং মহিলাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার আর্জি জানিয়েছে কমিশন। পাশাপাশি ‘দায়ী’ সরকারি আধিকারিকদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করারও দাবি জানানো হয়েছে রিপোর্টে।
‘ভোট পরবর্তী হিংসা’ রুখতে রিপোর্টে উল্লিখিত সুপারিশ মেনে দ্রুত পদক্ষেপ করার আবেদন জানিয়েছে কমিশন। সেই সঙ্গে আদালতের নির্দেশ মেনে চলা হচ্ছে কি না, সেই বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করার আর্জিও জানানো হয়েছে।
কমিশনের ‘ভোট পরবর্তী হিংসা’-র রিপোর্ট প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৃহস্পতিবার বলেন, ‘‘রাজ্য প্রশাসনের বক্তব্য না শুনেই এই রিপোর্ট তৈরি করেছে কমিশন। আমাদের বিশ্বাস, রাজ্যকেও হলফনামা পেশ করার সুযোগ দেবে আদালত। আর রাজ্যের আইন শৃঙ্খলার পরিস্থিতির দায়িত্বে তখন নির্বাচন কমিশন ছিল। আমি আর কিছু বলতে চাই না।’’