পরতে পরতে ইতিহাস, তবুও অবহেলিত

বাংলার প্রাচীনতম গ্রন্থাগার। শিক্ষা ও স্বাধীনতা আন্দোলনেও অবদান রয়েছে। আজ সোমবার বিশ্ব বই দিবসে মেদিনীপুরের ঋষি রাজনারায়ণ বসু স্মৃতি গ্রন্থাগারের হাল জানালেন বরুণ দেবাংলার প্রাচীনতম গ্রন্থাগার। শিক্ষা ও স্বাধীনতা আন্দোলনেও অবদান রয়েছে। আজ সোমবার বিশ্ব বই দিবসে মেদিনীপুরের ঋষি রাজনারায়ণ বসু স্মৃতি গ্রন্থাগারের হাল জানালেন বরুণ দে

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৮ ২৩:২৪
Share:

অবহেলায়: এভাবেই রাখা রয়েছে বই । ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল

উনিশ শতকে বাংলায় ৫৫টি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এই গ্রন্থাগারগুলোর মধ্যে প্রাচীনতম মেদিনীপুরের ঋষি রাজনারায়ণ বসু স্মৃতি গ্রন্থাগার। নামেই প্রকাশ বাংলার নবজাগরণের এক অন্যতম মুখ এই গ্রন্থাগারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মেদিনীপুর শহরের সুপ্রাচীন এই গ্রন্থাগার তৈরির ইতিহাসের সঙ্গে বাংলায় ব্রিটিশ শাসকদের শিক্ষাব্যবস্থা প্রসারের প্রচেষ্টাও জড়িত।

Advertisement

গ্রন্থাগারের সলতে পাকানোর শুরু ১৮৩৪ সালে। ওই বছর লর্ড বেন্টিঙ্ক জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশনের প্রধান পদে টমাস বেবিংটন মেকলেকে নিয়োগ করে বঙ্গে শিক্ষার মানোন্নয়ন ও প্রসারের জন্য রিপোর্ট জমা দিতে বলেন। মেকলে তাঁর রিপোর্টে লেখেন, ‘বর্তমানে আমাদের এমন একটি উচ্চমানস সম্বন্ধীয় দোভাষী গোষ্ঠীর প্রয়োজন যাঁরা স্থানীয় নেটিভ ও আমাদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করবেন। তাঁদের অন্তরে খাঁটি ভারতীয়ত্ব থাকবে কিন্তু তাঁরা রুচিতে, নৈতিকতায় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে খাঁটি ইংরেজদের মতো হবেন’। সে জন্য তিনি বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, গ্রামেগঞ্জে প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার এবং শহরাঞ্চলে সাধারণ গ্রন্থাগার স্থাপনের সুপারিশ করেন।

কিন্তু বাস্তবে ছিল অন্য চিত্র। জনসাধারণের অজ্ঞতা দূরের সদিচ্ছা লক্ষ্য করা যায়নি। তবে মেকলের রিপোর্টের পরে একটা উদ্যোগ নজরে এসেছিল। রিপোর্ট পেশের দু’দশক পরে হেনরি বেলি মেদিনীপুরে পাবলিক লাইব্রেরি স্থাপনে উদ্যোগী হলেন। ১৮৫৮ সালের ক্যালকাটা গেজেটে প্রকাশিত হেনরি রিকেটসের ‘মেদিনীপুর রিপোর্ট’ থেকে জানা যায়, বেলি সাহেবের উদ্যোগে স্থানীয় জমিদার ও শিক্ষানুরাগীরা ১৮৫২ সালে দু’হাজার চারশো টাকার তহবিল তৈরি করে মেদিনীপুর পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। কিছু দিন পরে বেলির আকস্মিক মৃত্যুর ফলে গ্রন্থাগার প্রসারের সরকারি উদ্যোগে ভাটা লক্ষ্য করা যায়।

Advertisement

১৮৫০ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদ অলংকৃত করার জন্য রাজনারায়ণ বসুকে অনুরোধ করেন। রাজনারায়ণ বসু সেই অনুরোধে সাড়া দেন। সেই পদে থাকার সুবাদে প্রশাসনের শিক্ষা বিষয়ক কর্মসূচিতে রাজনারায়ণ বসু জড়িত থাকতেন। স্বাভাবিক ভাবে মেদিনীপুর পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার কাজেও তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। কলেজিয়েট স্কুলের প্রধানশিক্ষক থাকাকালীন তিনি শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারক রূপে মেদিনীপুরে পরিচিত হন। এই সময়ে তিনি একটি সান্ধ্যকালীন বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র এবং একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নেন। গোড়ায় বেলি সাহেব ছিলেন এই লাইব্রেরির সভাপতি। রাজনারায়ণ বসু ছিলেন সম্পাদক। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আখড়া ও শিক্ষার স্থান ছিল লাইব্রেরিটি। বেলি সাহেবের মৃত্যুর পরে মেদিনীপুর পাবলিক লাইব্রেরির নাম পরিবর্তন করে তিনি ‘বেলি হল পাবলিক লাইব্রেরি’ করার যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

বাংলার নবজাগরণের সূচনাপর্বে গ্রন্থাগার আন্দোলন উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গিয়েছে। এই আন্দোলন মফফ্সল শহর এবং গ্রামাঞ্চলেও এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত প্রায় প্রত্যেক স্থানীয় অধিবাসী মেদিনীপুর পাবলিক লাইব্রেরির সদস্য হয়েছিলেন। সেই সময় হেনরি রিকেটস্ ইংরেজি জানা ভারতীয়ের কাছে গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ইতিবাচক রিপোর্ট জমা দিয়েছিলেন প্রাদেশিক সরকারের কাছে। তাঁর রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে ১৮৫৪ সালের ১১ জানুয়ারি এ রকম সমমানের গ্রন্থাগার প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়।

১৮৮৫ সালে ৪৮ জন গ্রাহক ছিলেন। এঁদের মধ্যে চারজন ইউরোপীয় এবং বাকিরা স্বদেশি। সেই সময় প্রতি মাসে গ্রাহক চাঁদা ছিল যথাক্রমে ২ টাকা, ১ টাকা ও ৮ আনা। একজন প্রথম শ্রেণির গ্রাহক, ছ’জন দ্বিতীয় শ্রেণির গ্রাহক এবং ৪১ জন তৃতীয় শ্রেণির গ্রাহক ছিলেন। মাসিক চাঁদা সংগ্রহ হত গড়ে ৩৯ টাকা। গড়ে সারা মাসে খরচ হতো ২১ টাকা। ঋষি রাজনারায়ণ বসু যতদিন মেদিনীপুরে ছিলেন, এই গ্রন্থাগারটিকে ‘পুত্রস্নেহে’ আগলে রেখেছিলেন। ১৮৯৯ সালে রাজনারায়ণ বসুর মৃত্যুর পরে গ্রন্থাগারটি তাঁর নামে করার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করা হয়। গ্রন্থাগারটির পরিবর্তিত নাম হয় ‘ঋষি রাজনারায়ণ বসু স্মৃতি গ্রন্থাগার’। ১৯০৩ সালে এখানে এসেছেন ভগিনী নিবেদিতা। ১৯৩৫ সালে শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৯০৩ সালে এবং ১৯০৮ সালে এসেছেন ঋষি অরবিন্দ। মেদিনীপুরেই এই গ্রন্থাগারটি ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের আখড়া। ১৯০৫ সালে এই গ্রন্থাগারে মিলিত হয়েই মেদিনীপুরের নাগরিকেরা বিদেশি জিনিস বর্জন করার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বিপ্লবী বিমল দাশগুপ্তও এই গ্রন্থাগারে লুকিয়ে রাত কাটিয়েছেন।

১৯৭৯ সালে সরকারি গ্রন্থাগার হিসেবে স্বীকৃতি পায় গ্রন্থাগারটি। বইয়ের সংখ্যা প্রায় সাড়ে বারো হাজার। ২৬৭টি দুষ্পাপ্য বই রয়েছে। ২৩টি পাণ্ডুলিপি রয়েছে। প্রাচীন এই গ্রন্থাগার এখনও জাতীয় সম্পদের স্বীকৃতি পায়নি। কবে পাবে, এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজাও দুরূহ। কিন্তু এখন কী হাল ইতিহাসের পরত নিয়ে টিকে থাকা এই গ্রন্থাগারটি? রঙ চটেছে। ইতিউতি পলেস্তারা খসে পড়েছে। তালপাতার বহু পুঁথি এই গ্রন্থাগারকে সমৃদ্ধ করেছে। বহু পুরাতন সংবাদপত্র ও সাময়িকীর সংগ্রহ গ্রন্থাগারটির সুনাম বৃদ্ধি করতে সাহায্য করেছে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রদর্শনশালা বিভাগের একটি গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, এই গ্রন্থাগারে রক্ষিত তালপাতার পুঁথি ও কাগজের পাণ্ডুলিপিগুলো বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্ত। নষ্ট হয়ে যেতে পারে। উচ্চশক্তিসম্পন্ন বিবর্ধক কাচের মাধ্যমে তো বটেই, খালি চোখেও এই নষ্টের প্রকোপ বোঝা যায়। এখানে রক্ষিত পাণ্ডুলিপিগুলো সংরক্ষণের প্রয়োজন। মূল্যবান পুঁথি ও পাণ্ডুলিপিগুলো অবহেলায় তোরঙ্গে, কাঠের র‌্যাকে, ভাঙা আলমারিতে বা অতি সাধারণ কাঠের আসবাবে রাখা।

বিগত দেড়শো বছরেরও বেশি সময় ধরে নানা গবেষক, ছাত্র, অধ্যাপক এই পাঠাগারের সাহায্য নিয়েছেন। এই গ্রন্থাগার সাহিত্য ও সংস্কৃতির আকরগ্রন্থের সংগ্রহশালা। কিন্তু এখন? ছোটরা আর গ্রন্থাগারে এসে বই পড়ে না। বড়দের ফুরসত কই! পাঠক টানতে কোনও উদ্যোগও নেই। গ্রন্থাগারে পছন্দের বই খুঁজে পেতে অনেক সময়ই সমস্যা হয়। মেদিনীপুরের এই গ্রন্থাগারেও এই সমস্যা নতুন নয়। এখন বেশ কিছু গ্রন্থাগারে এক ক্লিকেই পছন্দের বইয়ের খোঁজ দিতে সূচীকরণ বা ক্যাটালগিংয়ের কাজ শুরু হয়েছে। এখানে অবশ্য হয়নি।

এ ভাবে ইতিহাস ধরে রাখা সম্ভব? জেলা গ্রন্থাগার আধিকারিক ইন্দ্রজিৎ পান আশ্বাস দিয়েছেন, “পরিকাঠামো উন্নয়নের বেশ কিছু কাজ হবে। পাঠকদের জন্যই গ্রন্থাগার। মানুষকে গ্রন্থাগারমুখী করতে নানা পরিকল্পনাও নেওয়া হচ্ছে।”

আশ্বাস আর বাস্তবের তফাৎ ঘুচলেই মঙ্গল!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement