তৃণমূলের মাটি সরছে, জঙ্গলমহলে বিজেপির উত্থানের পিছনে ‘অন্য শক্তি’!

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বয়স তখন বড়জোর মাস ছ’য়েক। শীতের রাত। রাত গভীর হওয়ার আগেই সব নিস্তব্ধতা ভেঙে এলোপাথাড়ি গুলির তীক্ষ্ণ-তীব্র আওয়াজ, সঙ্গে আর্ত চিৎকার। কয়েক মিনিট পরেই শ্মশানের নিস্তব্ধতা।

Advertisement

সিজার মণ্ডল

বাঁশপাহাড়ি (ঝাড়গ্রাম) শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৮ ১০:৪২
Share:

জঙ্গলমহলে পিছু হটছে তৃণমূল, উত্থান বিজেপির।নিজস্ব চিত্র।

অযোধ্যা পাহাড়ের যে ঢালটা বলরামপুরের দিকে নেমে এসেছে, সেই ঢালেই ঘন জঙ্গল শুরু হওয়ার আগে শেষ গ্রাম খুনটাঁড়। সাত বছর আগে গাড়ি চড়ে কোনওমতে ঘাটবেড়া পর্যন্ত গেলেও খুনটাঁড় পর্যন্ত বাকি রাস্তা হেঁটেই যেতে হত। এখন পুরোটাই গাড়ি যায়। রাস্তা বদলালেও গ্রামের শেষ সীমানায় ঢালাই রাস্তার ধারে পাঁচিল ঘেরা টিনের চালের বাড়িটা একই আছে। পার্থক্য একটাই।

Advertisement

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বয়স তখন বড়জোর মাস ছ’য়েক। শীতের রাত। রাত গভীর হওয়ার আগেই সব নিস্তব্ধতা ভেঙে এলোপাথাড়ি গুলির তীক্ষ্ণ-তীব্র আওয়াজ, সঙ্গে আর্ত চিৎকার। কয়েক মিনিট পরেই শ্মশানের নিস্তব্ধতা। সে দিন রাতে ভয়ে গ্রামের কেউ বাড়ি থেকে বেরোতে পারেননি। সকালে এই বাড়ির উঠোনেই পাওয়া গিয়েছিল অজিত সিংহ সর্দার এবং তাঁর ছেলে মহেশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া দেহ, সঙ্গে পোস্টারে ‘পুলিশের চর’-এর তকমা। সেই উঠোনেই বাবুই দড়িতে বোনা চারপাইয়ের উপর বসে নিজের মনে বিড়বিড় করে উঠলেন রাজেন সিংহ সর্দার, “সে দিন গোটা দলটা ছিল কুড়ি-বাইশ জনের। রঞ্জিৎ পাল নিজে ছিল। আমাদের গ্রামেরও ক’জন ছিল। ওরা আমাকেই খুঁজছিল। কপাল জোরে ওদের চোখ এড়িয়ে পাঁচিল টপকে গোটা রাত জঙ্গলে কাটিয়েছিলাম।”

নিজের বাড়ির সামনে রাজেন সিংহ সর্দার।

Advertisement

সে দিন অযোধ্যার মাওবাদী কমান্ডার রঞ্জিৎ পাল মেনে নিতে পারেননি, তাঁদেরই এক সময়ের সহযোগী তৃণমূলে নাম লেখাবে। রাজেন এখনও তৃণমূলই করেন। বোন কুমকুম এর আগে গ্রাম পঞ্চায়েতে জিতলেও এ বার জেলা পরিষদের প্রার্থী হিসেবে বিজেপির কাছে গো-হারা হেরেছেন। হিসেবটা মেলাতে পারছেন না রাজেন— কারা নিঃশব্দে সবার অলক্ষ্যে জঙ্গলের গভীরে থাকা ছোট্ট ছোট্ট আদিবাসী গ্রামে রটিয়ে দিয়েছে, এই সরকার আদিবাসী-মূলবাসীদের জমিতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাট্টা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে! ঠিক একই ভাবে হিসেব মেলেনি ঝাড়গ্রামের বিনপুর-২ ব্লকের জঙ্গলে ঘেরা গ্রামগুলিতেও।

আরও পড়ুন:

জঙ্গলমহলে ভরাডুবি, মন্ত্রিসভায় বদল এনে আদিবাসীদের ভার নিলেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই

মমতাকে প্রধানমন্ত্রী করতে শপথ নিন: অভিষেক

ওদলচুঁয়া প্রাথমিক স্বাস্থকেন্দ্রের পিছনের পাঁচিলের পর থেকেই শুরু হচ্ছে জঙ্গল। সেখানেই গাছের তলায় মঙ্গলবার দুপুরে কয়েকশো মানুষের জমায়েত।

ওদলচুঁয়াতে আদিবাসী মঞ্চের বৈঠক।

ঘাসের উপর চাটাই পেতে বৈঠক। এখানে শিমুলপাল, বাঁশপাহাড়ি এবং ভুলাভেদা গ্রাম পঞ্চায়েতের দখল নিয়েছে আদিম আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চ। ওখানেই ছিলেন এই সংগঠনের অন্যতম নেতা ‘জগপরগনা’ হরিপদ কিস্কু। তাঁর দাবি, এই মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে জঙ্গলখণ্ডের আদিবাসী মূলবাসী জাতিসত্তা রক্ষার উদ্দেশ্যে। হরিপদর অভিযোগ, “আমরা কখনও তৃণমূল, কখনও বা সিপিএমকে ভোট দিয়েছি। কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দলই আমাদের জাতিসত্তার স্বীকৃতি দেয়নি। আমাদের ধর্ম, ভাষা বা আমাদের সংস্কৃতির প্রতি সম্মান দেখায়নি। তাই আজ আমরা নিজেদের সংগঠন তৈরি করেছি।”

নির্বাচনের মাসখানেক আগে এই সব প্রান্তিক গ্রামে শাসক দলের হয়ে প্রচারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সরকারের সেফ কাস্টডিতে থাকা রঞ্জিৎ পালকে। তখনও কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পাননি তলে তলে সরে গিয়েছে পায়ের মাটি। গোটা এলাকাতে মঞ্চের কোনও দেওয়াল লিখন তো দূরের কথা, একটা পোস্টারও নেই। প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের উল্টো দিকেই বাড়ি সুভাষ মাহাতোর। তাঁর কথায়: “ভোটের দু’দিন আগে পর্যন্ত শাসক দলের ডাকা প্রতিটা মিটিংয়ে ভিড় যা ছিল তাতে বোঝার উপায় ছিল না যে মানুষ অন্য কিছু ভাবছে।” একই অভিজ্ঞতা খুনটাঁড়ের রাজেনেরও। তাঁর কথায়, “কোনও এক অদৃশ্য শক্তি সব ওলটপালট করে দিল!”

সেই শক্তি কি শুধুই বিজেপি? না রয়েছে অন্য কোনও অনুঘটকও?

ঘাটবেরার একসময়ের মাওবাদী নেতা সুধীর মণ্ডলের স্ত্রী ও ছেলে।

রাজেনের বাড়ি থেকে সওয়া কিলোমিটার দূরে বাড়ি সুধীর মণ্ডলের। লালগড় আন্দোলনের সময় এই এলাকায় আদিবাসী-মূলবাসী জনগণের কমিটির সক্রিয় সদস্য ছিলেন এই সুধীর। মাওবাদী কার্যকলাপের জন্য তিন বার গ্রেফতারও হয়েছেন। তাঁর বাড়ি গিয়ে জানা গেল, পুলিশ তাঁকে ফের গ্রেফতার করেছে। তাঁর ছেলে শিবরামের অভিযোগ, “বাবা কয়েক মাস ধরে বিজেপি করছে। আর তাই মিথ্যা মামলায় তাঁকে পুলিশ ধরেছে।” এর আগেও কথা হয়েছিল সুধীরের সঙ্গে। অঘোর হেমব্রমের মতো ওই কমিটিতে তাঁর অন্য সহকর্মীরা তৃণমূলে যোগ দিলেও, জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সেই পথে যাননি সুধীর। শুধু সুধীর নন, তাঁর অনেক পুরোন সহকর্মীই এখন বিজেপির সক্রিয় কর্মী।

রাজেনের কথাটা কতটা সত্যি তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন বিনপুরের সাগর বাস্কে, শৈলেন সরেনরা। সত্যিই ফের কোনও এক অদৃশ্য শক্তি ওলটপালট করছে জঙ্গলমহলে। ঠিক দশ বছর আগে এক নভেম্বরের দুপুরে এই আদিবাসী সমাজের নেতারাই রাস্তায় নেমেছিলেন পুলিশি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। তাঁদের নেতৃত্বে এককাট্টা আদিবাসী সমাজ বিভিন্ন জায়গায় একঘরে করে দিয়েছিল অনেক সিপিএম পরিবারকে। বিনপুরের ধবনী, লালডাঙার মতো গ্রামে আদিবাসী সমাজের নির্দেশ উপেক্ষা করে তৃণমূল করার জন্য আদিবাসী সমাজ একঘরে করে দিয়েছিল সাগর-শৈলেনদের। প্রশাসন দিয়ে সমস্যা মেটেনি। আদিবাসী সমাজকে সন্তুষ্ট করেই এই বয়কট তোলা সম্ভব হয়েছে। এই দৃশ্য সত্যিই অস্বস্তিতে ফেলেছে প্রশাসনকে। রাজেন, সাগর, শৈলেনদের মতো তাঁরাও টের পাচ্ছেন একটা শক্তির অস্তিত্ব যা দেখা যাচ্ছে না কিন্তু ফের সক্রিয় জঙ্গলের বুকে। কেউ আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে নারাজ।

কিন্তু আতঙ্ক যে বাসা বেঁধেছে প্রশাসনের অন্দরে তা অনেকটাই স্পষ্ট। নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরই তড়িঘড়ি মাওবাদী দমনের জন্য বিশেষ বাহিনী কাউণ্টার ইন্সারজেন্সি ফোর্সের (সিআইএফ) দায়িত্ব দেওয়া হয় সিদ্ধনাথ গুপ্তকে। কেএলও-র বিরুদ্ধে অপারেশনের সফল এবং অপারেশন লালগড়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়া এই আইপিএস সম্প্রতি পাহাড়ে বিমল গুরুঙ্গের বাহিনীকেও এলাকা ছাড়া করেছিলেন। সেই অফিসারকে ভাবনাচিন্তা করেই এই মুহূর্তে সিআইএফের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে মত শীর্ষ পুলিশকর্তাদের।

মঙ্গলবার ভোর হওয়ার আগেই যখন সিআইএফের দু’টি প্লাটুনকে শিরকাবাদ হয়ে গোবরডির ঘন জঙ্গলে ঢুকতে দেখলেন আশপাশের গ্রামের মানুষ, তখন তাঁরা একেবারে অবাক যে হননি, তা নয়। তবে অবাক হওয়ার থেকেও নিঃসংশয় হয়েছেন এই ভেবে যে, তাঁদ‌ের অনুভূতিটা ভুল ছিল না। সিআইএফ কর্তাদের দাবি, এটা রুটিন প্রশিক্ষণ। কিন্তু একই দিনে অযোধ্যা পাহাড়ের বিভিন্ন প্রান্তে সিআইএফের রাতভর চলা এই ‘প্রশিক্ষণ’-এর মোড়কে প্রকৃত লক্ষ্য যে কী, তা হয়তো গ্রামবাসীদের অজানা নয়!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement