ছেলেধরা গুজব নতুন নয়, নতুন হচ্ছে ধ্যানধারণা

এ দেশে এখন সদাই বিবাদ। পড়শি বাড়ি, পড়শি গাঁ, পড়শি রাজ্য— কেউ কারও বন্ধু নয়। হীনতা নিজ সংজ্ঞায় সংস্থাপিত। লিখছেন তিলোত্তমা মজুমদার।‘বহিরাগত’ শব্দটির রাজনৈতিকীকরণ হওয়ার সূচনাপর্ব ঐতিহাসিক। বস্তুত, ভারতে বহিঃশত্রুর আক্রমণের পর্ব এতই পৌনঃপুনিক, এতই দীর্ঘ, যে শক, হুন, পাঠান, মোগল, ফরাসি, পর্তুগিজ, ইংরেজ সবাই ভারতীয় সংস্কৃতির মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৮ ০৩:০২
Share:

ছেলেধরা গুজব নতুন নয়। নতুন হল ছেলেধরা সম্পর্কে ধ্যানধারণা।

Advertisement

শিশুপাচার চক্র বা অপরাধপ্রবণ মানুষের হাতে যাতে বাচ্চারা না পড়ে, তার জন্য ‘ছেলেধরা’ সম্পর্কে ধারণা নানান গল্পের মধ্যে দিয়ে ছোটদের মনে সঞ্চার করা হত। তার থেকে উদ্‌গত ভীতি ছিল ছোটদের রক্ষাকবচের মতো। কথায় কথায় গণপিটুনি এবং অচেনা লোক মানেই সন্দেহভাজন— এমন পরিস্থিতি সাম্প্রতিক।

কত বছর, কত দিন গণনা করলে বলা যেতে পারে, অমুক সামাজিক প্রবণতা রীতি নয়, মড়কের মতো সর্বগ্রাসী সাম্প্রতিক হাওয়া?

Advertisement

‘বহিরাগত’ শব্দটির রাজনৈতিকীকরণ হওয়ার সূচনাপর্ব ঐতিহাসিক। বস্তুত, ভারতে বহিঃশত্রুর আক্রমণের পর্ব এতই পৌনঃপুনিক, এতই দীর্ঘ, যে শক, হুন, পাঠান, মোগল, ফরাসি, পর্তুগিজ, ইংরেজ সবাই ভারতীয় সংস্কৃতির মধ্যে ঢুকে পড়েছে। সে সব ইতিহাসবিদের বিশ্লেষ্য। সমস্যা হল, স্বাধীন ভারতে কুটিল স্বার্থান্বেষ দ্বারা যখন গ্রামে-শহরে রাজনৈতিক গণ্ডি কাটা হয়। পশ্চিমবঙ্গে এই লক্ষণ প্রকট হলে ক্ষোভে, প্রতিবাদে শঙ্খ ঘোষ ‘বহিরাগত’ কবিতা লেখেন। তারপর কেন্দ্রে ও রাজ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। কিন্তু অপহৃত বিশ্বাস, সততা, সহিষ্ণুতা, সম্মানবোধ ইত্যাকার মানবিক গুণগুলি ফিরে আসেনি।

এই গত কয়েকদিন এ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে গণপিটুনির নানান ঘটনা, যাতে নির্দোষ ব্যক্তি আছেন, সম্মাননীয় শিক্ষক আছেন, যা নিয়ে রাজনৈতিক চাপান-উতোর চলছে, তার থেকে সমাজের কোন কোন দিক ধরা পড়ে?

প্রথম লক্ষ্যণীয় অসহিষ্ণুতা। একজন ব্যক্তি নিজস্ব পরিচয়সূত্রটুকু দেবার অবকাশ পাচ্ছেন না। তার আগেই তিনি প্রহৃত হচ্ছেন। গণপ্রহারে অপমানিত হওয়া, আহত অথবা মৃত। কখনও উদ্দেশ্যমূলক ভাবে কেউ প্ররোচনা দিয়ে থাকেন, কখনও প্ররোচনার সঠিক উৎস খুঁজে পাওয়াই কঠিন। মূল বিষয়, সন্দেহভাজন সাধারণ মানুষের একজন, যাঁরা আইনের পরোয়া না করে মারধর করছেন, তাঁরাও জনসাধারণ। কেন মানুষ এমন অধীর এবং মারমুখী হয়ে পড়ছেন?

নিরাপত্তাহীনতার বোধ নিশ্চয়ই দায়ী। প্রশাসনের প্রতি আস্থা থাকলে এই বোধ এমন তীব্র হত কি? অন্যায় এবং অপরাধের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক তৎপরতা এবং আইনের উপযুক্ত হস্তক্ষেপ থাকলে এই অনাস্থা তৈরি হত কি? শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে যেমন জীবাণুবাহিত রোগের প্রবণতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়, ঠিক তেমনই সমাজ-কাঠামোয় দুর্বলতা থাকলে সুবিধাভোগীরা তার সুযোগ নেয়।

মুশকিল হল, শিশু ও নারীপাচার চক্র বিশ্ব জুড়ে সক্রিয়। ভারতের মতো উন্নয়নশীল কিন্তু আসলে দরিদ্রের দেশে দেহব্যবসা এবং ভিক্ষাজীবীর সংগঠিত চক্র নিদারুণভাবে সাম্রাজ্য চালায়। কিডনি-পাচার চক্র, এমনকী, মৃতদেহের বেআইনি ব্যবসাও প্রবল আকারে চলে। এই সংক্রান্ত যে কোনও রটনা জনসাধারণকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলবেই। কিন্তু যে কোনও পরিস্থিতিতেই আইন লঙ্ঘন করার অধিকার কারও থাকতে পারে না। যে যুক্তিতে খাপ পঞ্চায়েতের রায় গ্রাহ্য নয়, যে যুক্তিতে স্থানীয় মাতব্বরের নির্দেশ যখন অত্যাচারের রূপ নিয়ে অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়, সেই একই কারণে গণপিটুনি, ত্রাস সঞ্চার, অসহিষ্ণু আক্রমণ নিন্দনীয় এবং অপরাধ। প্রশাসনের প্রতি অনাস্থা এতদূর প্রসারিত যে, সাধারণ মানুষ পুলিশের উপর চড়াও হচ্ছেন— এই ঘটনাও প্রায়ই ঘটতে দেখা যাচ্ছে।

প্রশাসনিক ব্যর্থতা এর একমাত্র দিক নয়। সামাজিক নিরাপত্তা দৃঢ়মূল করে অর্থনৈতিক সাফল্য। সামাজিক সুবিধার সুষম বণ্টন। স্বাধীন ভারতে তথা পশ্চিমবঙ্গে আজও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থানের মতো মৌলিক ক্ষেত্রগুলি সুস্থিত নয়। যে শিক্ষা ও সচেতনতা থাকলে গুজব রটিয়ে হানাহানির চক্রান্ত ব্যর্থ হতে পারে, তা থেকে, প্রতিটি রাজনৈতিক শক্তি জনসাধারণকে বঞ্চিত করেছে। নিরাপত্তাহীন প্রাণীমাত্রেই মারমুখী, আক্রমণাত্মক। মানুষ একেবারেই তার ব্যতিক্রম নয়।

মানুষে মানুষে বিভেদ যত বেশি করা যায়, স্বার্থদুষ্ট ক্ষমতার তত বেশি লাভ। বিভেদ বাড়ানোর অসংখ্য প্রক্রিয়া আছে। এ ধর্ম ও ধর্ম, সাদা রং কালো রং, উঁচু জাত বনাম নিচু জাত, উঁচু নাক বসা নাক, পাহাড়ি সমতলি! রাজনীতির এই সংকীর্ম স্বার্থবুদ্ধির অসুখে সারা ভারত আক্রান্ত! কারণ একেবারে গোড়া থেকে এই বিভেদবোধ চাড়িয়ে দেওয়া হয়। যে কলেজটিতে জাতিগত সংরক্ষণের জন্য যোগ্যতা সত্ত্বেও কেউ জায়গা পেল না, তার মধ্যে জাত্যভিমান এবং বঞ্চনাজনিত ক্ষোভ প্রবেশ করল। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও একই কথা! আপাতভাবে, যত ক্ষোভ, যত বঞ্চনা, তত বেশি বিদ্রোহ-সম্ভাবনা এবং ক্ষমতামুখী অসৎ রাজনীতির পক্ষে ততই বিপদ! তাই চেতনা স্ফুরিত হওয়ার আগেই সংগঠিত বিক্ষোভ হত্যার চক্রান্ত চলে। সামাজিক অস্থিরতা জারি রাখা হয়। উত্তেজনা প্রশমনের পথে মানুষ অর্থহীন বিবাদ করে ধর্ম নিয়ে, দল নিয়ে, এ পাড়া ও পাড়া নিয়ে। তাদের ভুলিয়ে রাখা হয়, বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষের জাত, ধর্ম সব এক।

আবার, ক্ষমতাবানের পারস্পরিক সমীকরণ শেষ পর্যন্ত মানুষকে দু’দলে ভাগ করে রাখে। সর্বহারা আর সর্বহর। এ দেশে এখন সদাই বিবাদ। পড়শি বাড়ি, পড়শি গাঁ, পড়শি রাজ্য— কেউ কারও বন্ধু নয়। হীনতা নিজ সংজ্ঞায় সংস্থাপিত।

সম্পূর্ণ রাজনীতিবিমুখ হওয়াই কি এর সমাধান? কিন্তু রাজনীতি তো করে আপনার-আমার ঘরের লোক। এ দেশে দুর্নীতিতে কম-বেশি জড়িত প্রতিটি মানুষ। ঠক বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। তাই ভাবতে হবে। আবেদন করতে হবে মানবিক চেতনার কাছে। নইলে, যে প্রগাঢ় দুঃসময় আমাদের, তার সর্বগ্রাসী সুনামির হাত থেকে কেউই মুক্তি পাবে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement