মুখ ফেরাচ্ছে শীতের অতিথিরা। ছবি: দেবরাজ ঘোষ
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। ছোটদের এক পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল। কমিকস স্ট্রিপের আকারে। একটা ঝিলের পাশে বাইনোকুলার হাতে কয়েকজন দাঁড়িয়ে। তারা পাখি দেখার চেষ্টা করছে। ওই ঝিলে পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা রয়েছে। কিন্তু পাখিরা আর কিছুতেই ঝিলে নামতে চাইছে না। আসছে, নামার চেষ্টা করছে...তারপর আবার উড়ে চলে যাচ্ছে। শেষে বোঝা গেল, ওই ঝিলের পাশে বিকট স্বরে সাউন্ড বক্স বাজিয়ে পিকনিকের আনন্দে মেতেছে কয়েকজন। সেই আওয়াজে ভড়কে গিয়ে উড়ে যাচ্ছিল পাখিগুলো।
বিজ্ঞাপনের ঝিলটা ছিল ভিনরাজ্যের। কিন্তু একই সমস্যার ভুক্তভোগী এ রাজ্যে আসা পরিযায়ী পাখিরাও। সময় বদলেছে। জায়গা বদলেছে। কিন্তু সমস্যা বদলায়নি।
ঝাড়গ্রাম জেলার গোপীবল্লভপুরের ঝিল্লি পাখিরালয় এবং বেলপাহাড়ির খাঁদারানি ঝিলে প্রচুর পরিযায়ী পাখি আসে। কিন্তু গত দু’বছরে দুই ঝিলেই পাখি আসা বেশ কমে গিয়েছে। এই দু’টো ঝিল ছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় আসা পরিযায়ী পাখির সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। এর কারণ কী? পক্ষী বিশারদেরা জানাচ্ছেন, এর অন্যতম কারণ, ওই এলাকাগুলো পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হওয়া। পর্যটনকেন্দ্রের থেকেও বড় বিপদ, এলাকাগুলোয় শীতকালে জমজমাট পিকনিক হয়। সাউন্ড বক্স বাজিয়ে হুল্লোড় চলে। ফলে নিরিবিলি পছন্দ করা পাখিরা বিরক্ত হয়। ঝাড়গ্রামের আদি বাসিন্দা শিবশঙ্কর গোস্বামী পাখি নিয়ে চর্চা করেন। স্কুলশিক্ষকতার জন্য বর্তমানে তিনি হাজারিবাগের বাসিন্দা। বেশ কয়েক বছর ধরে নিয়মিত ঝাড়গ্রামে পাখি-পর্যবেক্ষণ করছেন শিবশঙ্করবাবু। তাঁর পর্যবেক্ষণ, ঝিল্লি পাখিরালয় ও বেলপাহাড়ির খাঁদারানি ঝিলে গত দু’বছরে বালি হাঁস এবং খড়িহাসের ঝাঁক আসাটা ভীষণরকম কমে গিয়েছে। ঝিল্লি পাখিরালয়ের আরেকটি সমস্যা, বোটিং। এই ঝিলে পর্যটকদের জন্য প্যাডেল বোটের ব্যবস্থা রয়েছে। পর্যটকদের জন্য পরিযায়ী পাখিরা সুস্থির থাকতে পারে না। পিকনিকের পরে থালা-গ্লাস, খাবারের ভুক্তাবশেষ জলে ফেলেন অনেকে। তাতে জল খারাপ হয়।
খাদ্যাভাবও পাখির সংখ্যা কমার অন্যতম কারণ বলে জানাচ্ছেন শিবশঙ্করবাবু। তাঁর মতে, জমিতে ব্যবহৃত কীটনাশক বৃষ্টির জলের সঙ্গে জলাশয়ে এসে পড়ে। তাতে গেঁড়ি, গুগলির সংখ্যা কমে। পাখিরা ঠিক মতো খাবার পায় না। আবার ওই কীটনাশকের প্রভাবে অনেক সময়ে পরিযায়ীদের মৃত্যুও হয়। পাখিরা জলাশয়গুলোয় আসতে চায় না। খুঁজে নেয় অন্য কোনও এলাকার জলাশয়। শিবশঙ্করবাবু বলছেন, “হাজার কিলোমিটার আকাশপথে পাড়ি দিয়ে পরিযায়ী পাখিরা তাদের প্রিয় জায়গায় এসে খাবার পাচ্ছে না। তাদের চিরচেনা জলাভূমির অস্তিত্বও কার্যত মুছে গিয়েছে। তখন সেই পরিযায়ীদের কী অবস্থা হয়, তা কী কখনও কেউ ভেবে দেখেছেন।”
শুধু পরিযায়ী পাখিরা নয়, অরণ্য শহর ঝাড়গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদেরও দেখা কম মিলছে। কয়েক বছর আগেও লালমুনিয়া, কালিশ্যামা, বাঁশপাতিদের হামেশাই দেখা যেত অরণ্যশহরে। দিনের আলো ফোটার আগেই ঝাড়গ্রাম শহরের গাছগাছালিতে হরবোলার আসর বসত পাখিদের। দীর্ঘদিন এই শহরে যাঁরা পাখি নিয়ে চর্চা করছেন, তাঁরাই জানাচ্ছেন, ঝাড়গ্রাম শহরে উদ্বেগজনক হারে কমে যাচ্ছে নানা প্রজাতির পাখি। কাক, চড়ুই তো কমেছেই। দেখা কম মিলছে ফিঙে, দোয়েল, কাঠঠোকরাদেরও। অথচ এগুলোই গ্রাম বাংলার প্রকৃত পাখি। কবিরাও গ্রাম-বাংলার বর্ণনায় দোয়েল, ফিঙে, শ্যামাকে বাদ দিতে পারেননি। ঘটনা হল, ঝাড়গ্রাম পাখিদের স্বাভাবিক বিচরণক্ষেত্র হওয়া উচিত। এই শহর চরিত্রের দিক দিয়ে অন্য শহরগুলো থেকে আলাদা। ঝাড়গ্রাম শহর শালগাছে ঘেরা। শহরের কেন্দ্রস্থল রবীন্দ্রপার্কের শালবনে কয়েক বছর আগেও অলস দুপুরে কাঠঠোকরাদের গাছ ঠোকার ঠকঠক আওয়াজ শোনা যেত। রবীন্দ্রপার্কের শালবন আর নেই। কংক্রিটের রাস্তায় মুখ ঢেকেছে লালমাটি। রয়ে গিয়েছে শুধু হাতে গোনা কিছু মৃতপ্রায় শালগাছ। কয়েকটা আবার শুকনো হয়ে হেলে পড়েছে। এই গাছে পাখিরা বাসা তৈরি করতে চাইবে না, সেটাই স্বাভাবিক।
গত পাঁচ-ছ’বছরে ঝাড়গ্রাম স্টেডিয়ামের সম্প্রসারণ, পুলিশের প্রশাসনিক দফতর তৈরির মতো নানা নির্মাণ কাজের জন্য কাটা পড়েছে অজস্র শালগাছ। শহরের রাস্তার দু’ধারে থাকা গাছগুলির বেশিরভাগ উধাও হয়ে গিয়েছে। গাছের অভাবে ঠাঁইনাড়া হচ্ছে পাখিরা। রবীন্দ্রপার্কের ভিতরেও শাল গাছের সংখ্যা কমে গিয়েছে। পার্কের ভিতর কংক্রিটের রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে। রমরমিয়ে চলছে রেস্তোরাঁ। তার ওপর সারা বছর বিভিন্ন সময়ে পার্কের মুক্তমঞ্চে সাউন্ড বক্স বাজিয়ে অনুষ্ঠান চলে। পাখিরা থাকবে কোথায়? শহরের অধিকাংশ জলাভূমি বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। রায়তি জমিতে থাকা গাছপালা সাফ করে দিয়ে একের পর এক বহুতল মাথা তুলছে। চিড়িয়াখানা যাওয়ার পথে ডিয়ারপার্কের জঙ্গল কার্যত সাফ করে শহরের সম্প্রসারণ ঘটানো হচ্ছে। কিন্তু বনসৃজনের নতুন কোনও উদ্যোগ করা হচ্ছে না। বন দফতরের অবশ্য বক্তব্য, শহরে বনভূমি তেমন নেই।
শহরের পুরনো বাসিন্দাদের সঙ্গে গল্প করলে জানা যায়, বছর দশেক আগেও রঘুনাথপুর এলাকার ঝোপেঝাড়ে তিতিরের ডাক শোনা যেত। শীত ফুরনোর সময়ে ভোরের আলো ফোটার আগে ডেকে উঠত কোকিল। ফাল্গুন-চৈত্রের বিকেলে হামেশাই দেখা যেত বসন্তের পাখি হিসেবে পরিচিত মোহনচূড়াকে। হুদহুদ পাখির নামই বাংলায় মোহনচূড়া। দীর্ঘ দু’দশক ধরে অরণ্যশহরের পাখি নিয়ে চর্চা করছেন মৃণ্ময় হোতা। বিনপুরের দহিজুড়ি মহাত্মা বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক মৃণ্ময়বাবু ঝাড়গ্রাম শহরের বাসিন্দা। তাঁর আক্ষেপ, “আমরা নিজেরাই অরণ্যশহরের বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসের দিকে নিয়ে চলেছি। শহরে নির্বিচারে সবুজ ধ্বংস ঠেকানো না গেলে অবশিষ্ট পাখিরাও শহর থেকে বিদায় নেবে।” একই কথা শিবশঙ্করবাবুর। তাঁর কথায়, “ঝাড়গ্রাম শহরে পাখিদের উপযোগী পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে, পাখিরা শহর ছেড়ে গভীর জঙ্গলমুখী হয়ে যাচ্ছে।’’
শহরের বাইরে বেরলেও একই ছবি। জামবনির কেঁদুয়া গ্রামের তেঁতুল গাছ প্রচুর শামুকখোলের আশ্রয় ছিল। কিন্তু তাদের সংখ্যাও আগের তুলনায় অনেক কমে গিয়েছে। কমে গিয়েছে মদনটাক পাখির সংখ্যাও। জুন-জুলাই শামুকখোলের প্রজনন ঋতু। খাবারে টান পড়ায় শামুকখোল, মদনটাক ধীরে ধীরে বিকল্প জায়গার সন্ধান করছে।
তবে এই কমতির মধ্যে ঝাড়গ্রাম রেলস্টেশনের মতো কিছু এলাকার পুরনো ঝাঁকড়া গাছগুলো আশার আলো। ওই গাছে হরিয়াল, নীলকণ্ঠ, টিয়া, চন্দনা, বুলবুলিদের দেখা যায়। শহর ছাড়িয়ে গেলে তালগাছে বাবুই পাখির বাসাও দোলে। দেখা যায় জঙ্গল ময়নাও। শহরের অদূরে চিড়িয়াখানার ঝিলে এখনও পানকৌড়িরা খেলা করে। জলাশয়ে মাঝের সন্ধানে ঝাঁপায় মাছরাঙারাও।
আশঙ্কা থেকেই যায়। শহর হাত-পা ছড়াচ্ছে দ্রুত। অরণ্যশহরের শ্রেষ্ঠ সম্পদ শাল, পিয়াশাল, কেঁদ, পলাশ, শিমূল এই সম্প্রসারণের হাতের কবলে পড়ে গেলেই মুশকিল।