সাড়ে চুয়াত্তর ছবিতে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মাসিমা মালপো খামু’ তো প্রবাদে পরিণত। ফাইল ছবি।
বাংলার ব্যবহারিক জীবনে বাঙাল ভাষা কি পথ হারাইয়াছে?
নইলে কি ‘কাদম্বিনী’ সিরিয়ালের টিআরপি পড়ে যাওয়ার একটা কারণ হিসেবে ‘বাঙাল ভাষার দাপাদাপি’-কে চিহ্নিত করা হয়? অথবা ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকদের মধ্যেও আর ‘মাইরা ফেলুম’, ‘কাইট্টা ফেলুম’ শোনা যায় না?
সিরিয়াল বা খেলার মাঠের ব্যাপারটা বাহ্য। মূল সমস্যা হল— ‘পূর্ববঙ্গীয় ভাষা’ নিয়ে অনীহা রয়েছে বঙ্গসমাজে। দেশভাগের সাত দশক পরেও কি এখনও ভাষাগত বিভাজন বাঙালি সমাজের তলায় তলায় কাজ করে চলেছে? নাকি পূর্ববঙ্গ থেকে আগত পরিবারের এই প্রজন্মের সদস্যরা তাঁদের পূর্বপুরুষের ভাষার সঙ্গে আর পরিচিত নন? প্রমিত বাংলা কি গ্রাস করে নিয়েছে তথাকথিত ‘বাঙাল’ ভাষাকে?
আরও পড়ুন:নির্যাতন ও অগণতন্ত্রের বিরোধিতায় আস্থা রাখি শিল্পে, কল্পনায়
কয়েক দশক আগেও বাংলা সিনেমার কমিক রিলিফের বড় অংশ জুড়ে থাকত বাঙাল ভাষা। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মাসিমা মালপো খামু’ তো প্রবাদে পরিণত। অথবা তাঁর কথিত বাঙাল ভাষায় ‘নবরামায়ণ’। বাঙালির বাল্যকালের অমল হাসির উপাদান টেনিদার গল্পে হাবুল সেন পটলডাঙার খাস ঘটি পরিমণ্ডলেও দিব্যি বাঙাল ভাষায় কথা বলে। খাস ঘটি দর্শক-পাঠকরা তাঁদের আদর করেই আপন করে নিয়েছিলেন।
টেনিদার সঙ্গী হাবুল বাঙাল ভাষায় কথা বলে সিনেমাতেও। ফাইল ছবি
আবার জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর উপন্যাস বা ঋত্বিক ঘটকের সিনেমায় বাঙাল ভাষা কমিক রিলিফ নয়। মনীশ ঘটকের ‘কুড়ানি’ কবিতার মেয়েটিও বাল্যে প্রেমিকের হাতে চড়-চাপড় খেয়ে বলেছিল, ‘‘তরে বুঝি কই নাই? আমিও বান্দরী?’’ বাগবাজারের খাল পেরলেই কলকাতা ফুরোল— এমন ভাবতেন যে সব বাগবাজারি বাবু, তাঁদের শেষ প্রতিনিধি ছিলেন পরেশ ঘোষ। সিল্কের লুঙ্গি আর খাদির ফতুয়ায় রক আলো করে আড্ডা দিতেন। বেধড়ক ঘটি পরেশকে একবার এক অর্বাচীন জিজ্ঞাসা করেছিল, কলকাতা বাঙালশূন্য হলে কি ভাল হত? উত্তরে খাপ্পা পরেশ বলেছিলেন, ‘‘পাড়ায় দু’একটা বাঙাল না থাকলে দুনিয়া অচল!’’
আরও পড়ুন:চোখের ঠুলি কবে খুলবে
দেশভাগের পর গড়ে ওঠা কলোনিগুলিতে দেশের মতো পরিবেশ গড়ে থাকতে চেয়েছিলেন পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা ছিন্নমূল মানুষ। রেশনের চাল, জীবিকা-ঘটিত অনিশ্চয়তার পাশাপাশি ছিল আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। সেই দিনগুলিতে উদ্বাস্তু কলোনিতে ‘দেশের ভাষা’ ছিল স্মৃতির সবথেকে বড় অবলম্বন। কিন্তু কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের অন্যত্র কি পাঁচ, ছয় বা সাতের দশকের তরুণরা পূর্ববঙ্গীয় ভাষা পরিহার করে ফেলেছিলেন? ঋত্বিকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’-য় মাস্টারমশাই বাঙাল ভাষায় কথা বললেও নীতা সর্বদা বলেনি।
ঋত্বিকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’-য় মাস্টারমশাই বাঙাল ভাষায় কথা বললেও নীতা সর্বদা বলেনি। ফাইল ছবি।
তা হলে কি পশ্চিমবঙ্গীয় পরিসরে বাঙাল ভাষা শুধুই পরিবেশ, পরিসর, ব্যক্তির সামাজিক অবস্থা ও অবস্থান অনুযায়ী ব্যবহৃত হয়েছে?
সমাজবিদ মানস রায়ের মতে, “বিষয়টা জটিল। চার বা পাঁচের দশকে পূর্ববঙ্গ থেকে আগতদের সকলেই কলোনির বাসিন্দা হননি। অনেকে উঠেছিলেন উত্তর ও মধ্য কলকাতার বিভিন্ন পাড়ায়। করনওয়ালিস স্ট্রিটের একটা পরিবার বাড়ির ভিতরে কথা বলত বাঙাল ভাষায়। কিন্তু পাশের বাড়ির বাসিন্দারা হিন্দিভাষী হওয়ায় তাদের সঙ্গে কথা বলত হিন্দিতে। আবার পাড়ার লোকেদের সঙ্গে কলকাতার বাংলায়।” নেতাজি নগরের উদ্বাস্তু কলোনিতে বড়-হওয়া মানসবাবুর বক্তব্য, “আমি ঘরে-বাইরে ঢাকার ভাষাতেই কথা বলতাম। কলকাতার বাংলা বলতে পারতাম না। আমার দিদি ছ’য়ের দশকে এক অফিসে চাকরি নেন। সেখানে কিন্তু তিনি কলকাতার ভাষাতেই কথা বলতেন। উদ্বাস্তু পরিবারের মেয়েদের জীবিকা অর্জনের তাগিদে দ্রুত ত্যাগ করতে হয়েছিল ‘দেশের ভাষা’। ছেলেদের ক্ষেত্রে সেই চাপ ততটা ছিল না।’’
অনেকেরই স্মৃতিতে রয়ে গিয়েছে বাঙাল ভাষা, জানালেন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের শীর্ষ কর্তা। ফাইল ছবি।
ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের শীর্ষকর্তা দেবব্রত (নীতু) সরকারের কথায়, “এই প্রজন্মের মধ্যে সত্যিই পুব বাংলার ভাষায় কথা বলার প্রবণতা কম। আমরাও ঠাকুমার সঙ্গে, মায়ের সঙ্গে এই ভাষায় কথা বলেছি। কিন্তু চর্চা কমে গিয়েছে ক্রমে। তবে সত্যিই কি ভাষার মৃত্যু হয়? বলার সুযোগ হয়তো নেই। কিন্তু অনেকেরই স্মৃতিতে রয়ে গিয়েছে এই ভাষা।”
সলিল সেন তাঁর ছবিতে উদ্বাস্তুদের ‘নতুন ইহুদি’ (১৯৫৩) বলেছিলেন। দেশহীন ইহুদিরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন, বজায় রেখেছেন হিব্রু ভাষার চর্চা। বাড়ির মেয়েরাই সেই ভাষা শেখাতেন পরের প্রজন্মকে। ইহুদিদের সামনে হৃত স্বদেশ পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন ছিল। ‘নতুন ইহুদি’-দের ছিল না। ‘ফেলে আসা গ্রাম’-এর স্মৃতি ক্রমেই লুপ্ত হয় আটের দশকে। কলোনিগুলোও তার পূর্বতন চেহারা বজায় রাখতে পারেনি। সেই পরিমণ্ডলে হারিয়ে যায় ঢাকা, বিক্রমপুর, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম, বরিশাল, পাবনা, যশোর থেকে বয়ে নিয়ে আসা ‘ডায়ালেক্ট’। ১৯৯০-পরবর্তী প্রজন্ম আর সেই ভাষা মাথায় রাখতে পারেনি। হুতোমের বাংলা, টেকচাঁদ ঠাকুরের বাংলা যেমন লুপ্ত হয়ে গিয়েছে, তেমনই লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ঢাকা-বিক্রমপুর-চট্টগ্রাম-নোয়াখালির ভাষাও।
‘কাদম্বরী’-র মুখে বাঙাল ভাষার বাড়াবাড়িতে ক্ষুণ্ণ হচ্ছেন সিরিয়ালের দৈনিক দর্শক। ফাইল ছবি।
সুরকার দেবজ্যোতি মিশ্র বেড়ে উঠেছেন চণ্ডীতলা কলোনিতে। তাঁর মতে, “ভাষার মধ্যে একটা সুর থাকে। যার সঙ্গে জীবনযাপনের একটা ভূমিকা থাকে। দেশভাগের পর থেকে জীবনযাপন এতটাই বদলেছে যে, ভাষার টোন্যালিটি বদলে যেতে বাধ্য। বর্তমান প্রজন্মের পক্ষে পূর্ববঙ্গের ভাষায় টিকে থাকা মুশকিল। ‘লবণ দিও তো’ আর কেউ বলে না। কারণ, সেটা এই প্রজন্ম শোনার সুযোগই পায়নি। জীবনছন্দ বদলের সঙ্গে সঙ্গে ‘লবণ’ কখন যেন ‘নুন’ হয়ে গেছে!”
আরও পড়ুন:মলমাসের দৌলতে কি এবার পুজোর ফুর্তি বাড়ছে বাঙালির
তাই ‘কাদম্বরী’-র মুখে বাঙাল ভাষার বাড়াবাড়িতে ক্ষুণ্ণ হচ্ছেন সিরিয়ালের দৈনিক দর্শক। আর ইস্টবেঙ্গল জনতার নিজস্ব বাঙাল ভাষা বিলীন হয়েছে বাংলায়।