হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বাবু মাস্টারকে দেখতে গিয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী। নিজস্ব চিত্র।
শনিবার রাতে মিনাখাঁ ফাঁড়ির কাছে তাঁর ওপর হামলা হওয়ার পর রাতারাতি পরিচিত তাঁর নাম। কোনওক্রমে প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন। পোশাকি নাম ফিরোজ কামাল গাজী। বাংলার রাজনীতিতে তাঁর পরিচয় ‘বাবু মাস্টার’ নামে। সিপিএম এবং তৃণমূল ঘুরে আপাতত বিজেপি-তে। এবং রাজ্য ও উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় শাসক শিবিরের একটা বড় অংশ মেনে নিচ্ছে, বাবু মাস্টারের উপর হামলা বসিরহাট এলাকায় তৃণমূলের উপর যথেষ্ট ‘বিরূপ প্রভাব’ ফেলবে। তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘ওই ঘটনা সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত। যারাই করে থাকুক, দায়টা এসে পড়ছে আমাদের উপরেই। প্রশাসনের উচিত, দায়িত্ব নিয়ে ওই হামলাকারীদের চিহ্নিত করে দ্রুত গ্রেফতার করা!’’
বাবু মাস্টারের উপরে হামলা নিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রত্যাশিত ভাবেই অভিযোগে সরব রাজ্য বিজেপি। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের প্রাক্তন কর্মাধ্যক্ষ বাবুকে নিয়ে বসিরহাট লোকসভা আসন এলাকায় শক্তি বাড়ানোই লক্ষ্য রাজ্য বিজেপি-র। সেটাই একদা সিপিএম থেকে তৃণমূলে যোগ দেওয়া বাবুকে বিজেপি-তে নিয়ে আসার বড় কারণ। রাজ্য বিজেপি নেতারা মনে করছেন, বাবুর উপর হামলার বড় প্রভাব পড়বে বিধানসভা নির্বাচনে বসিরহাট লোকসভা এলাকা তথা উত্তর ২৪ পরগনার অন্যান্য বিধানসভা আসনে। যা আদতে তাঁদেরই সুবিধা করে দেবে। রাজ্য বিজেপি-র মুখপাত্র প্রণয় রায় সোমবার বলেন, ‘‘এটা তো লোকে বুঝছে যে, তৃণমূলের পায়ের তলার মাটি যত দুর্বল হচ্ছে, ততই তারা রক্তের রাজনীতি করতে চাইছে!’’
প্রসঙ্গত, গত লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে বিজেপি-র ১৮ জন সাংসদ জিতলেও প্রাপ্তক ভোটের নিরিখে ১২১টি বিধানসভা কেন্দ্রে এগিয়ে ছিল তারা। একমাত্র বসিরহাট লোকসভায় একটিও বিধানসভা এলাকায় এগোতে পারেনি গেরুয়া শিবির। সর্বত্র পিছিয়ে ছিলেন বিজেপি প্রার্থী সায়ন্তন বসু। সেই সময় বিজেপি-র সাংগঠনিক জেলা বসিরহাটের মধ্যেই ছিল বনগাঁ লোকসভা এলাকার স্বরূপনগর বিধানসভা। বনগাঁ লোকসভা আসনে শান্তনু ঠাকুর ছ’টি বিধানসভা এলাকা থেকে জয় পেলেও স্বরূপনগর বিধানসভায় প্রায় ২৪ হাজার ভোটে এগিয়ে ছিল তৃণমূল। ২০১৪ সালের উপনির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী শমীক ভট্টাচার্য বসিরহাট দক্ষিণ কেন্দ্রে জিতলেও পরে ২০১৬ সালের নির্বাচনে তিনি হেরে যান। ফলে শক্তি বাড়াতে বাবু মাস্টার ছাড়াও উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের আরও এক কর্মাধ্যক্ষ রতন ঘোষকে দলে নেয় বিজেপি। রতন যোগ দেন গত ১২ ডিসেম্বর। আর বাবু ১৯ ডিসেম্বর মেদিনীপুরে অমিত শাহের সভায় শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে।
তবে হাসনাবাদের বাবুকে দলে নেওয়া নিয়ে তখন কার্যত দু’ভাগ ছিল রাজ্য বিজেপি। মত ছিল না সঙ্ঘ পরিবারেরও। বিজেপি-র আদি নেতাদের বক্তব্য ছিল, সিপিএম এবং তৃণমূলে থাকার সময়ে সঙ্ঘ এবং বিজেপি-র অনেক কর্মীর উপরে অত্যাচারের অভিযোগ রয়েছে বাবুর বিরুদ্ধে। কিন্তু সেই আপত্তি টেকেনি। ‘নব্যদের চাপে’ই বিজেপি-তে যোগ দেন বাবু। হামলার পর হাসপাতালে ভর্তি বাবুকে দেখতে গিয়েছিলেন শুভেন্দু। এখন তৃণমূল নেতাদের একাংশ মনে করছেন, বাবুর উপর ‘অপরিণামদর্শী’ হামলার ঘটনায় বসিরহাট এলাকায় বিজেপি এককাট্টা হয়ে গিয়েছে। বাবু মাস্টার এমনিতে এলাকায় যথেষ্ট জনপ্রিয়। স্থানীয় মানুশের একাংশের মতে, তাঁর উপর হামলার ঘটনায় আসন্ন বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের বড় ক্ষতি হবে।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলে মন্ত্রী গৌতম দেবের ‘প্রশ্রয়েই’ হিঙ্গলগঞ্জের রাজনীতিতে বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খাওয়াতেন পেশায় স্কুলশিক্ষক এই নেতা। সুন্দরবনের হিঙ্গলগঞ্জের যে প্রান্তে তাঁর বাড়ি, সেই ভবানীপুরে বাবুর দাপটেই বছরের পর বছর মিছিল করতে পারেনি বিরোধীরা। যে কারণে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা নেতৃত্বের ‘গুড বুকে’ ছিলেন বাবু মাস্টার। হাসনাবাদ মডেল হাইস্কুলের শিক্ষক থাকাকালীনই ভেড়ি এবং ইটভাটাগুলিত নিজের প্রভাব বাড়িয়েছিলেন। যা লাল পার্টির এলাকা দখলের কাজে এসেছিল। তাই খোলা হাতে হিঙ্গলগঞ্জ এবং হাসনাবাদ এলাকার ভোট ম্যানেজের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁর উপর।
এমনই ছিল তাঁর দাপট যে, ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বসিরহাটের তৃণমূল প্রার্থী হাজি নুরুল ইসলাম প্রচারে যেতে পারেননি ওই গ্রামে। কিন্তু ওই ভোটই রাজ্যে পট পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিতে শুরু করে। ‘হাওয়া মোরগ’ বাবু পরিবর্তনমুখী হতে খুব দেরি করেননি। বসিরহাটে হাজি নুরুল জয়ী হওয়ার পর তাঁ সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন বাবু মাস্টার। দলবদল করে সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে আসতে দরবার শুরু করেন সাংসদের কাছে। প্রথম দিকে রাজি না হলেও ২০১০ সালে বসিরহাটের তৃণমূল সাংসদের হাত ধরেই তৃণমূলে আসেন বাবু।
প্রথম দিকে হিঙ্গলগঞ্জের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলেও ধীরে ধীরে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে তৃণমূলের উচ্চ নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন বাবু। ততদিনে রাজ্যে ক্ষমতায় এসে গিয়েছে তৃণমূল। দলের অন্দরে সাপ-সিঁড়ির খেলা দ্রুত বুঝে নিয়ে জেলা সভাপতি তথা মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন বাবু। বসিরহাট লোকসভা এলাকায় নিজের প্রভাব বাড়াতে শুরু করেন। দলের নেতারা জানেন, একটা সময় ছিল, যখন বসিরহাটের রাজনীতি বাবুর চোখ দিয়েই দেখতে শুরু করেছিলেন জ্যোতিপ্রিয়। তাঁর একনিষ্ঠ অনুগামী হয়েই জেলার রাজনীতিতে নিজের জায়গা পাকা করে নেন বাবু। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে হিঙ্গলগঞ্জ থেকে জেলা পরিষদ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন বাবু মাস্টার। রাজ্যের প্রভাবশালী মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয়র দৌলতেই জেলা পরিষদের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক বিভাগের কর্মাধ্যক্ষ হন বাবু মাস্টার। সাংগঠনিক ভাবে হাসনাবাদ ব্লকের পর্যবেক্ষক-সহ বসিরহাট লোকসভার আহ্বায়ক করা হয়েছিল।
বসিরহাটের এক তৃণমূল নেতা সোমবার বলেন, ‘‘হিঙ্গলগঞ্জ বিধানসভা তফসিলি আসন হওয়ায় বসিরহাট উত্তরে তৃণমূল প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন বাবু। সে বিষয়ে দলের একাংশের আশ্বাসও পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ওই আসনের দাবিদার ছিলেন প্রাক্তন বিধায়ক এ টি এম আবদুল্লা। পাশাপাশি, প্রশান্ত কিশোরের ‘আইপ্যাক’ সংস্থার সৌজন্যে বসিরহাট উত্তরের সিপিএম বিধায়ক তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় বাবুর টিকিট পাওয়ার সব আশা শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাই ও বিজেপি-তে যোগ দেয়।’’ তৃণমূলের ওই নেতা ভুল বলেননি। গত নভেম্বরে বসিরহাট উত্তরের সিপিএম বিধায়ক রফিকুল ইসলাম মণ্ডল তৃণমূলে যোগ দিলে শুভেন্দুর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন বাবু। বিজেপি-র রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গেও কয়েক দফা বৈঠকও হয় তাঁর। সেই খবর জানাজানি হতে কড়া হতে শুরু করে তৃণমূল। চাপে পড়ে জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষের পদ ছাড়েন বাবু। ১৯ ডিসেম্বর মেদিনীপুরে শুভেন্দুর সঙ্গে যোগ দেন বিজেপি-তে। তার পরেই বসিরহাট লোকসভা এলাকা জুড়ে বিজেপি-র সাংগঠনিক কাজ শুরু করেন।
এলাকার লোকজন জানাচ্ছেন, বসিরহাটে নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ানোর পাশাপাশি বিস্তর জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছেন বাবু। মূলত তাঁর উপর ভর করেই বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্র এলাকায় লড়তে নেমেছিল বিজেপি। একর পর এক দল বদলানোয় বাবুর ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ সামান্য হলেও টাল খেয়েছিল। কিন্তু শনিবার রাতের হামলা তাঁর জমি আবার পোক্ত করে দিয়েছে। বিধানসভা ভোটে যার খেসারত দিতে হতে পারে তৃণমূলকে।