বাংলা আকাদেমিতে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
কোভিড-কাল পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গে সরকারি স্কুলে প্রাথমিকে ভর্তি বেড়েছে। একেবারে শেষ সারিতে নয় স্কুলে উপস্থিতির হারও। স্কুলে মেয়েদের উপস্থিতির হারও অতিমারির পরে কমেনি। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, এক ক্লাস নীচের (দ্বিতীয় শ্রেণির) বই গড়গড়িয়ে পড়তে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছে তৃতীয় শ্রেণির পড়ুয়ারা। প্রাথমিকের অনেক ছাত্রছাত্রীই অঙ্কের বই খুলে আটকে যাচ্ছে সাধারণ বিয়োগ করতে গিয়ে।
শুধু তা-ই নয়। সমীক্ষা বলছে, দেশে টিউশন-নির্ভরতা সব থেকে বেশি এ রাজ্যের সরকারি স্কুলের পড়ুয়াদের মধ্যেই। যার অন্যতম কারণ হিসেবে উঠে আসছে স্কুলে পর্যাপ্ত সংখ্যায় শিক্ষক না থাকাও।
রাজ্যে সরকারি স্কুলে পড়াশোনার হালের এই ছবি বুধবার উঠে এসেছে অসরকারি সংস্থা ‘প্রথম’-এর বার্ষিক রিপোর্টে। এ দিন বাংলা আকাদেমির সভাঘরে যা প্রকাশিত হয়েছে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ বিশিষ্টদের উপস্থিতিতে।
রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর অবশ্য দাবি, ‘‘সারা দেশে শিক্ষায় আমরা যে এগিয়ে, তা আবার প্রমাণিত হল। তবে করোনা পরবর্তীকালে পড়ুয়াদের শেখার বিষয়ে একটা ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতিও আমাদের সরকারি স্কুলের শিক্ষকেরা দ্রুত মিটিয়ে দেবেন।’’
এ দিন প্রকাশিত অ্যানুয়াল স্টেটাস অব এডুকেশন রিপোর্ট (আসের) অনুযায়ী, ২০২২ সালে পশ্চিমবঙ্গে ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সিদের ৯২.২ শতাংশই ভর্তি হয়েছে সরকারি স্কুলে। সারা দেশে সেই ভর্তির হার ৭২.৯ শতাংশ। কিন্তু এ বছরেই নির্দিষ্ট একটি দিনে স্কুলে গিয়ে দেখা গিয়েছে, উপস্থিতির হার ৬৮.২%। পড়ুয়ারা আদৌ কতটা শিখছে, তা নিয়েও উদ্বেগের কারণ রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, এ রাজ্যে তৃতীয় শ্রেণির পড়ুয়াদের মাত্র ৩২.৬% দ্বিতীয় শ্রেণির বই গড়গড়িয়ে পড়তে পারছে। প্রাথমিকের ৩২.৪% পড়ুয়াই সাধারণ বিয়োগ করতে পারছে না। যদিও অন্যান্য রাজ্যের ছবিও এ বিষয়ে তেমন উজ্জ্বল নয়।
এ দিন ভিডিয়ো বার্তায় প্রথম-এর সিইও রুক্মিনী বন্দ্যোপাধ্যায় পরিসংখ্যান তুলে ধরে জানান, কোভিড-কালের পরে সরকারি স্কুলে ভর্তির প্রবণতা বেড়েছে। এমনকি অঙ্গনওয়াড়িতেও। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ ভারতের স্কুলগুলিতে ভর্তির সঙ্গে স্কুলে উপস্থিতির হারের সাযুজ্য বেশি। উত্তর এবং পূর্ব ভারতের স্কুলে সেই ফারাক রয়েছে। রুক্মিনী জানান, প্রাথমিকে পড়ুয়াদের শেখার মান সর্বভারতীয় স্তরে বেশ খারাপ। পশ্চিমবঙ্গেও তা সন্তোষজনক নয়। সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের পড়ুয়াদের মধ্যে সরকারি স্কুলে পড়ার প্রবণতা বেশি। এ ক্ষেত্রে রাজ্য শীর্ষে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে টিউশন নেয় ৭৮.২% পড়ুয়া। গৃহশিক্ষকদের উপরে নির্ভরতা বিহারে ৭১.১%।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরীর মতে, এই পরিসংখ্যানে উদ্বেগের কারণ আছে। স্কুলে ভর্তির হার বাড়লেও কোভিডের আগে পড়ুয়াদের পড়াশোনার যে মান ছিল, তা ছোঁয়া যায়নি ২০২২ সালেও। কোভিডের আগেও যে পড়াশোনার মান উল্লেখযোগ্য রকম ভাল ছিল, তা-ও নয়। কিন্তু তা আরও নেমেছে। সুকান্তের মতে, ‘‘শিক্ষক নিয়োগ বাড়ানো দরকার। স্কুলের পরিকাঠামোর উন্নতিতে সরকার কী করছে, সেটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’’
অভিজিৎ বলেন, ‘‘অনেক অভিভাবক মনে করেন, সরকারি চাকরি পেতেই স্কুলে পড়া। এই ধারণায় বদল আনতে হবে।’’ তাঁর মতে, ‘‘অনেক মা-বাবা মনে করেন, তাঁদের সন্তান সরকারি চাকরিই যদি না পায়, তা হলে পড়াশোনা করে কী লাভ? কিন্তু সারা পৃথিবীতে দেখা গিয়েছে, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পরে যে উপার্জন করা সম্ভব, দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়লে তার থেকে বেশি উপার্জন করা যায়। সব স্তরেই শিক্ষার মূল্য আছে।’’
এ দিন এই রিপোর্ট প্রকাশ ও তার বিশ্লেষণী আলোচনাসভার আয়োজন করে ‘প্রথম’ এডুকেশন ফাউন্ডেশন এবং লিভার ফাউন্ডেশন। সেখানে বিক্রমশীলা এডুকেশন রিসোর্স সোসাইটির অধিকর্তা শুভ্রা চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘(সরকারি স্কুলে) শিক্ষকদের পড়াশোনার বাইরে স্কুলে নানা কাজ করতে হয়। সিলেবাস (পাঠ্যক্রম) শেষ করতে ক্লাসে পড়ানোর সময় বাড়াতে হবে। শুধু পাঠ্যক্রম ধরে পড়ানোই শেষ কথা নয়। পড়ুয়ারা বিষয়টি সম্পর্কে সঠিক ভাবে জানতে পারছে কি না, তা-ও দেখা দরকার। শিক্ষকেরা অতিরিক্ত সিলেবাস-নির্ভর হয়ে যাচ্ছেন।’’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত লিভার ফাউন্ডেশনের মুখ্য উপদেষ্টা চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরী। সেখানে উঠেছে জোশীমঠের প্রসঙ্গও। অনুষ্ঠানে উপস্থিত অনেকের বক্তব্য, জোশীমঠে যে ধস নামতে পারে, তা বোঝা গিয়েছিল অনেক আগেই। কিন্তু তখন তা অগ্রাহ্য করার কারণেই আজ এই সঙ্কট। এখন থেকে রাজ্য তথা দেশের শিক্ষার গুণগত মানে আরও বেশি করে নজর না দিলে, বড় বিপদ অপেক্ষা করছে সামনে।