চাকরি ছেড়ে আইন পড়ে বিচার আদায়

এ যেন সত্যি হলেও গল্প! এমন ‘প্লট’ পেলে যে কোনও চিত্রনাট্যকার লুফে নেবেন।সুবিচার আদায় করতে এক ছাপোষা শিক্ষক নিশ্চিন্ত চাকরির আশ্রয় ছেড়ে আইন পড়া শুরু করলেন। আইন পাশ করে নিজের মামলা নিজে লড়ে জিতলেন। পুরো বৃত্তটা সম্পূর্ণ হতে লাগল পঁচিশ বছর।

Advertisement

সুব্রত সীট

দুর্গাপুর শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:৩৩
Share:

প্রদীপকুমার রায়

এ যেন সত্যি হলেও গল্প! এমন ‘প্লট’ পেলে যে কোনও চিত্রনাট্যকার লুফে নেবেন।

Advertisement

সুবিচার আদায় করতে এক ছাপোষা শিক্ষক নিশ্চিন্ত চাকরির আশ্রয় ছেড়ে আইন পড়া শুরু করলেন। আইন পাশ করে নিজের মামলা নিজে লড়ে জিতলেন। পুরো বৃত্তটা সম্পূর্ণ হতে লাগল পঁচিশ বছর।

বর্ধমানের অন্ডালে স্বরূপানন্দ আশ্রমপল্লির বাসিন্দা প্রদীপকুমার রায় তখন পঁচিশ বছরের যুবক। রানিগঞ্জে এক বেসরকারি স্কুলে সবে ইংরেজির শিক্ষকতা শুরু করেছেন। সেই সময় পাড়ারই এক পরিবারের তিন যুবক রাস্তায় মেয়েদের সঙ্গে অভব্য আচরণ করতেন। প্রতিবাদ করেন প্রদীপবাবু। সে জন্য তাঁর বোনকে কটূক্তির মুখে পড়তে হয়। শাসানো হয় তাঁর পরিবারকেও। সেখানেই শেষ নয়। প্রদীপবাবুর অভিযোগ, ১৯৯১ সালের ২৪ জুলাই অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাড়িতে চড়াও হয় ওই তিন যুবক। প্রদীপবাবুর হাতে কোপ মারা হয়। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে আক্রান্ত হন বাবা ও বোন। পাড়ায় বোমাও পড়ে।

Advertisement

ঘটনার পরপরই অন্ডাল থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিলেন প্রদীপবাবুর বোন। প্রদীপবাবুর দাবি, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার ধারায় মামলা হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু পুলিশ যে ধারায় মামলা করে, তাতে সহজেই তারা জামিন পেয়ে যায়। এলাকায় বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে। প্রদীপবাবু বলেন, ‘‘আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কোনও ধারণা না থাকায় পুলিশের উপরেই তাঁদের নির্ভর করতে হয়। সেই সুযোগে যে কত অপরাধী ছাড়া পেয়ে যায়, সে দিন তা পরিষ্কার বুঝতে পারি। তখনই ঠিক করি, কিছু একটা করতে হবে।’’

এর পরই প্রদীপবাবুর লড়াই শুরু। ঠিক করলেন, নিজে আইন পড়ে মামলা লড়বেন। পরের বছরই স্কুল থেকে অনুমতি জোগাড় করে হাজারিবাগে পড়তে যান। এলএলবি পাশ করার আগেই ছেড়ে দেন স্কুলের চাকরি। ওকালতির জন্য বার কাউন্সিলের অনুমতি পান ২০০১-এ। এই দশ বছরে দুর্গাপুর আদালতে তখনও কিন্তু প্রদীপের পরিবারের উপরে হামলার মামলা বিশেষ এগোয়নি। এ বার সরকারি আইনজীবীর সঙ্গে শুনানিতে নিজে সওয়াল শুরু করেন প্রদীপ। সেই রায় হতে হতেও ১৫ বছর গড়িয়ে গেল।

এর জন্য অবশ্য আক্ষেপ নেই বাহান্নয় পা দেওয়া প্রদীপবাবুর। বরং তিনি খুশি, শেষ অবধি বিচার মিলেছে। তাঁর কথায়, ‘‘আইনজীবী হিসেবে যোগ দিয়ে বুঝতে পেরেছি, তদন্ত ও সওয়াল ঠিক মতো না হওয়ায় অভিযুক্তদের অনেক সময় সুবিধে হয়ে যায়। এই মামলার ক্ষেত্রে যেমন আমার রক্তমাখা জামা কোর্টে পেশই করেনি পুলিশ। আমি আইনজীবী হিসেবে সেই প্রশ্ন তুলি।’’ এমন নানা খুঁটিনাটি বিষয় তুলে ধরায় তাঁর মামলা অন্য মাত্রা পায়, দাবি প্রদীপবাবুর। লম্বা লড়াই শেষে গত ২২ ডিসেম্বর রায় দিয়েছেন দুর্গাপুরের তৃতীয় এসিজেএম আদালতের বিচারক শৌভিক দে। দোষী সাব্যস্ত তিন ভাইয়ের তিন বছরের জেল হয়েছে। তবে প্রথমেই জামিনযোগ্য ধারায় মামলা রুজু হওয়ায় এখনই জেলে যেতে হয়নি অভিযুক্তদের। উচ্চ আদালতে আবেদনের জন্য সময় পেয়েছেন তাঁরা। সেই আবেদন তাঁরা করবেন বলেও জানিয়েছেন তাঁদের আইনজীবী রঞ্জিত রায়। সরকার পক্ষের আইনজীবী অনমিত্রা দেব বলেন, ‘‘প্রদীপবাবু আগাগোড়া লেগে ছিলেন। দেরিতে হলেও দোষীরা সাজা পেল, এটাই শান্তির।’’

বিচার তো মিলল। এখন? থেমে যেতে চান না প্রদীপবাবু। তাঁর মতে, সাধারণ মানুষ অনেক সময়েই উপযুক্ত আইনি সহায়তা পান না। কখনও পুলিশ ঠিক মতো সাহায্য করে না। তাঁর কথায়, ‘‘আমি নিজে আইন না জানলে দোষীরা আদৌ সাজা পেত কি না সন্দেহ। কিন্তু শুধু নিজের জন্য নয়, অনেককে সাহায্য করব বলে আইন পড়েছি। দুঃস্থ, অসহায় কেউ সমস্যায় পড়লে আইনি সহায়তা করাই এখন আমার লক্ষ্য।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement