তাড়িয়ে কেন দোষ দেওয়া, প্রশ্ন টাটার

অনিচ্ছুক চাষিরা অভিযোগ তুলেছিলেন, টাটারা সিঙ্গুরের জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় রেখে চলে গিয়েছে। টাটার তরফে আজ পাল্টা জবাব এল, ছক কষে গায়ের জোরে উৎখাত করে এখন ফেলে চলে যাওয়ার দায় চাপানো চলবে না।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৬ ০৪:৫৩
Share:

অনিচ্ছুক চাষিরা অভিযোগ তুলেছিলেন, টাটারা সিঙ্গুরের জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় রেখে চলে গিয়েছে। টাটার তরফে আজ পাল্টা জবাব এল, ছক কষে গায়ের জোরে উৎখাত করে এখন ফেলে চলে যাওয়ার দায় চাপানো চলবে না। টাটাদের দাবি, অনেক সময়েই পাগলামির কোনও ব্যাখ্যা মেলে না। কিন্তু তার পিছনেও একটা ছক কাজ করে— ‘মেথড ইন ম্যাডনেস’। সিঙ্গুর থেকে ন্যানো প্রকল্প উৎখাতের পিছনেও এমন ছক ছিল।

Advertisement

সিঙ্গুর নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আজ নাম না করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর সরকারের দিকেই আঙুল তুলল টাটা মোটরস। তাদের আইনজীবীরা অভিযোগ তুললেন, প্রথমে দুর্গাপুর হাইওয়ে অবরোধ করে রেখে টাটা মোটরসকে সিঙ্গুর থেকে ন্যানো প্রকল্প সরিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। ২০১১-য় নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেই সিঙ্গুর আইন করে মাঝ রাতে টাটার থেকে জমির দখল নিয়ে নেয়। সরকারের ওই প্রথম সিদ্ধান্তকেই অসাংবিধানিক বলে খারিজ করে দেয় কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ। সুপ্রিম কোর্টে যায় রাজ্য সরকার। সেই মামলার চূড়ান্ত পর্যায়ের শুনানি শুরু হয়েছে বিচারপতি ভি গোপালগৌড় ও বিচারপতি অরুণকুমার মিশ্রর বেঞ্চে। রাজ্যে শেষ দফার ভোটের আগে আজ এই শুনানিতে বারবারই উত্তেজক পরিস্থিতি তৈরি হয় এজলাসে।

অনিচ্ছুক চাষিদের আইনজীবীরা অভিযোগ তোলেন, টাটারা সিঙ্গুরের জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় রেখে চলে গিয়েছে। পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছোড়েন টাটার আইনজীবী, অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি ও সিদ্ধার্থ মিত্র। অভিষেক বলেন, ‘‘কারখানার জন্য লগ্নি ছাড়াও শুধু জমি ঘিরতেই ১৮০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। গাড়ির প্রোটোটাইপ-ও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তার পর দুর্গাপুর হাইওয়ে অবরোধ করা হয়। যাতে কিছুই ঢুকতে বা বেরোতে না পারে। পরিত্যক্ত ফেলে যাওয়া হল ইচ্ছাকৃত ভাবে চলে যাওয়া। আমাদের সরে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। পুরোটাই আসলে ‘মেথড ইন ম্যাডনেস’।’’

Advertisement

টাটারা যে সিঙ্গুরে লগ্নি করেও তা থেকে কোনও লাভ তুলতে পারেনি, তা মেনে নিয়েছেন বিচারপতি মিশ্র। কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতির এ-ও প্রশ্ন, কত বছর টাটা এই ভাবে জমি ফেলে রাখতে পারে?

অনিচ্ছুক কৃষকদের তরফে দাবি করা হয়েছে, শিল্পায়নের নাম করে টাটাদের জন্য জমি নিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। বিচারপতি মিশ্রর মন্তব্য, ‘‘ওরা যুক্তি দিতে পারে যে, পশ্চিমবঙ্গ শিল্পায়নের নিরিখে পিছিয়ে থাকা রাজ্য। তাই এমনটা করতে হয়েছিল।’’ এখন টাটাদের ক্ষতিপূরণের প্রসঙ্গ এলে কে তা দেবে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ।

এই যুক্তি মানতে চাননি অনিচ্ছুক চাষিদের আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রশান্ত ভূষণ, কলিন গঞ্জালভেসরা। কল্যাণ দাবি করেন, টাটারা ২০০৮ সালেই চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিল যে তারা সিঙ্গুর থেকে সরে যাচ্ছে। তার পরও তিন বছর জমি ফেলে রেখেছিল। সিঙ্গুরে জমি নেওয়ার প্রশ্নে জনস্বার্থের কথা বলা হয়েছিল। আসলে জনস্বার্থের মোড়ক ব্যবহার করে টাটা মোটরসের নির্দিষ্ট প্রকল্পের জন্যই জমি নেওয়া হয়। শিল্পোন্নয়ন নিগমকে ব্যবহার করা হয়েছিল টাটার মুখোশ হিসেবে।

জমি অধিগ্রহণকে বেআইনি আখ্যা দিয়ে এপিডিআর (অ্যাসোসিয়েশন অব পিপলস ডেমোক্র্যাটিক রাইটস)-এর তরফে প্রশান্ত ভূষণ বলেন, এই যুক্তিতে যে কোনও বেসরকারি শিল্পকেই জনস্বার্থমূলক প্রকল্প বলে আখ্যা দেওয়া যায়। কিন্তু বেসরকারি সংস্থার জন্য সরকার এই ভাবে জমি অধিগ্রহণ করতে পারে না। তা করতে হলে যে সব নিয়ম মানতে হয়, তা মানা হয়নি। জমি অধিগ্রহণের বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ার দু’মাস আগে টাটা সিঙ্গুরে ছোট গাড়ির কারখানার কথা ঘোষণা করে দিয়েছিল। শিল্পায়নের জন্য জমি নিলেও রাজ্য তা ইচ্ছেমতো টাটাকে দিয়ে দিতে পারে না। গঞ্জালভেস যুক্তি দেন, সিঙ্গুরের জমি উর্বর, তিন ফসলি। বিকল্প জমি না পেলেই এই ধরনের কৃষিজমি অধিগ্রহণ করা যায়। অনিচ্ছুক চাষিদের তরফে শান্তিরঞ্জন দাস যুক্তি দেন, কৃষকদের আপত্তি শোনা হয়নি। ২৬ হাজার পুলিশ নামিয়ে জমি অধিগ্রহণ করা হয়।

উল্টো দিকে ইচ্ছুক চাষিদের তরফে হাজির বিকাশ ভট্টাচার্য যুক্তি দেন, ৮০ শতাংশ কৃষক ক্ষতিপূরণ নিয়েছেন। তাঁরা চান, ওখানে শিল্পই হোক। বাস্তব হল, সিঙ্গুরে যে কৃষিজমি ছিল, তার চরিত্র বদল হয়ে গিয়েছে। সেখানে এখন শুধু শিল্পই হতে পারে। টাটারাও জানিয়েছে, তারা কোনও ক্ষতিপূরণ দেননি। নিগমের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী টাটাদের শুধু লিজের ভাড়া দেওয়ার কথা ছিল। রাজ্য জানিয়েছে, প্রায় হাজার একর জমির জন্য প্রথম ৫ বছরের জন্য বছরে এক কোটি টাকা, তার পর ৫ বছর অন্তত ২৫% বৃদ্ধি, ৩০ বছর পরে বছরে ৫ কোটি টাকা ভাড়া, ১০ বছর অন্তর ৩০% বৃদ্ধি, ৬০ বছরের পর থেকে ৯০ বছর পর্যন্ত ২০ কোটি টাকা— এই ভাবে ভাড়া ঠিক হয়েছিল। আগামিকালও এই মামলার শুনানি চলবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement