সাংবাদিক সম্মেলনে স্বপন দাশগুপ্ত। নিজস্ব চিত্র
নাগরিক সংগঠনের ব্যানারে এ বার আক্রমণ তীব্র আক্রমণে গেরুয়া শিবির। পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের উপরে মুখ্যমন্ত্রীর এত রাগ কেন? এই প্রশ্ন তুলে রবিবার তৃণমূলের বিরুদ্ধে আক্রমণের সুর আরও চড়িয়ে দিলেন রাজ্যসভার সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত। মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে বিজ্ঞাপন দিয়ে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) না মানার কথা ঘোষণা করছেন, তাতে রাজ্যে সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরি হয়েছে বলে তিনি এ দিন মন্তব্য করেছেন। বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন এবং কেন্দ্রের তরফেও পাল্টা বিজ্ঞাপন আসছে— রবিবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে এ কথা জানিয়েছেন স্বপন।
বিজেপির ব্যানারে নয়, ‘জাতীয়তাবাদী নাগরিক মঞ্চের’ ব্যানারে রবিবার সাংবাদিক সম্মেলন ডাকা হয়েছিল কলকাতা প্রেস ক্লাবে। সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত, গত লোকসভা নির্বাচনে হওড়া আসন থেকে বিজেপির টিকিটে লড়া রন্তিদেব সেনগুপ্ত, রাজ্য বিজেপির উদ্বাস্তু সেলের নেতা মোহিত রায়, বিজেপির রাজ্য কমিটির সদস্য শিশির বাজোরিয়া এবং গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অচিন্ত্য বিশ্বাস— মূলত এই পাঁচ জনই সাংবাদিক সম্মেলন করেন। সংসদে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাশ হওয়ার পর থেকে টানা দিন দিন পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে যে অশান্তি চলছে, তার প্রেক্ষিতেই এই সাংবাদিক সম্মেলন ডাকা হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সরাসরি আক্রমণ করে স্বপন দাশগুপ্ত সেখানে প্রশ্ন তোলেন, ‘‘পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের উপরে ওঁর কিসের এত রাগ? সিএএ-র মাধ্যমে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়া হচ্ছে, আর উনি সেটা বাধা দিচ্ছেন! ট্রেন পুড়ছে, বাস পুড়ছে!’’ সিএএ এবং এনআরসির বিরোধিতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্য জুড়ে যে প্রতিবাদ এবং মিছিলের ডাক দিয়েছেন, সে প্রসঙ্গে বিস্ময় প্রকাশ করেন বিজেপি নেতা তথা সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত। পূর্ববঙ্গ থেকে চলে আসা হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনীহা রয়েছে বলে তিনি ইঙ্গিত দেন। তার পরে বলেন, ‘‘উনি (মমতা) তা হলে খোলাখুলি বলুন যে, আমি ওঁদের নাগরিকত্ব দিতে চাই না।’’
সকালেই অবশ্য আক্রমণের সুর চড়িয়েছিলেন স্বপন। টুইটারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তীব্র আক্রমণ করে তিনি লিখেছিলেন যে, পশ্চিমবঙ্গে সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরি হয়ে গিয়েছে। তিনি লেখেন, ‘‘সিএবি-র মাধ্যমে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কার্যকরী করবে না বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা করে মুখ্যমন্ত্রী ইচ্ছাকৃত সংবিধানের ২৫৬ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করছেন। নিজের হিংসাত্মক ভোটব্যাঙ্ককে সহায়তা করতে তিনি সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরি করছেন।’’ সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদে কী লেখা রয়েছে, তা-ও তুলে ধরেন সাংসদ। রাজ্যের প্রশাসনিক ক্ষমতা এমন ভাবে প্রয়োগ করতে হবে, যাতে তা সংসদে পাশ হওয়া আইন বা চালু আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে এবং তার জন্য রাজ্যকে যে নির্দেশ দেওয়ার প্রয়োজন ভারত সরকার মনে করবে, সেই নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা সরকারের থাকবে— এ কথাই ২৫৬ অনুচ্ছেদে লেখা রয়েছে। সুতরাং সংসদে পাশ হওয়া আইন মানবেন না বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংবিধান লঙ্ঘন করছেন— ব্যাখ্যা স্বপন দাশগুপ্তর।
রাজ্যসভায় স্বপন দাশগুপ্ত মনোনীত সাংসদ ঠিকই। কিন্তু বিজেপি নেতা হিসেবে তাঁর পরিচিতি এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। শুধু তাই নয়, নরেন্দ্র মোদী এব অমিত শাহের আস্থাভাজন হিসেবেও তিনি পরিচিত। ফলে প্রথমে টুইটারে এবং তার পরে সাংবাদিক সম্মেলন করে স্বপন দাশগুপ্ত সাংবিধানিক সঙ্কটের অভিযোগ তোলায় বিষয়টি বিশেষ তাৎপর্য পেয়ে গিয়েছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মত।
নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের প্রয়োগ বাংলায় কী ভাবে হবে, সে বিষয়ে রাজ্যসভায় অমিত শাহকে প্রশ্ন করেছিলেন স্বপন দাশগুপ্তই। বিষয়টি স্পষ্ট করে জানানোর অনুরোধ করেছিলেন। অমিত শাহও স্পষ্ট জানান, গোটা দেশের মতো পশ্চিমবঙ্গেও নাগরিকত্ব আইন কার্যকর করা হবে। কিন্তু এখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিজ্ঞাপন দিয়ে জানাচ্ছেন যে, পশ্চিমবঙ্গে ওই আইন কার্যকরী হতে দেবেন না। তাই এ দিন ওই বিজ্ঞাপন নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন স্বপন দাশগুপ্ত। বিষয়টি নিয়ে যে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গেও আলোচনা করেছেন, তা-ও জানিয়েছেন স্বপন।
‘‘সিএএ এবং এনআরসি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে একটা ইচ্ছাকৃত অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। সুতরাং সিএএ কী, তা কাদের জন্য, তাতে কাদের লাভ হবে— এটা বুঝিয়ে একটা বিজ্ঞাপন কেন্দ্রীয় সরকারেরও দেওয়া উচিত, এ কথা আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছি। তিনি আমার কথা মেনে নিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, সিএএ সম্পর্কে বাংলা ভাষায় একটি বিজ্ঞাপন দু’তিন দিনের মধ্যেই সম্প্রচার করা শুরু হবে।’’
পড়ুন টুইট:
কিন্তু যে সাংবিধানিক সঙ্কটের অভিযোগ বার বার তুলছেন স্বপন, সে বিষয়ে কি অমিত শাহের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে? সাংসদ বলেন, ‘‘সে বিষয়েও কথা হয়েছে।’’
শুধু স্বপন নন, রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসুও এই প্রসঙ্গেই এ দিন সুর চড়িয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে সরকারি বিজ্ঞাপন দিয়ে একজন কী ভাবে বলতে পারেন যে দেশের আইন মানি না? এই প্রশ্ন তুলে মামলা করা হচ্ছে বলে সায়ন্তন এ দিন জানিয়েছেন। অর্থাৎ রাজ্য সরকারের তরফ থেকে সম্প্রচারিত এই বিজ্ঞাপনকে যে বিজেপি তথা কেন্দ্র মোটেই হালকা ভাবে নিচ্ছে না, তা স্পষ্ট।
শুধু তৃণমূলকে বা রাজ্য সরকারকে নয়, গেরুয়া শিবির এ দিন বাংলার সুশীল সমাজের একাংশকেও আক্রমণ করেছে। রাজ্যের নানা প্রান্তে যাঁরা তাণ্ডব চালাচ্ছেন, স্পষ্ট ভাষায় তাঁদের নিন্দা কেন করছে না সুশীল সমাজ? এই প্রশ্ন তুলে তাঁর আক্রমণ, ‘‘এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এবং বিকৃত মানসিকতা।’’
একই সুরে আক্রমণ করেছেন বিজেপির উদ্বাস্তু সেলের নেতা মোহিত রায়ও। তাঁর কথায়, ‘‘এ রাজ্যে যাঁরা বিশিষ্ট জন হিসেবে পরিচিত, তাঁদেরকে দেখছি টেলিভিশনে। তাঁরা বলছেন, গণতান্ত্রিক পথে আন্দোলন করাই ভাল। কিন্তু যে হিংসার তাণ্ডব রাজ্য জুড়ে চলছে, তার নিন্দা এঁরা একবারও করছেন না।’’
বিজেপি-কে এ দিন পাল্টা আক্রমণ করেছে তৃণমূলও। সাংসদ তথা রাজ্যসভায় তৃণমূলের দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন এ দিন বলেছেন, ‘‘বিজেপি এখন জ্ঞান দিচ্ছে! অসম, ত্রিপুরা-সহ গোটা উত্তর-পূর্বকে অশান্ত করে দিয়েছে। এই দেশকে দেওয়ার মতো ইতিবাচক কিছুই নেই বিজেপির কাছে। তারা শুধু ঘৃণা এবং বিভাজন ছড়ায়।’’