(বাঁ দিকে) রাজীব কুমার এবং (ডান দিকে) শুভেন্দু অধিকারী। —ফাইল চিত্র।
রাজ্য পুলিশের অস্থায়ী ডিজি করা হয়েছে রাজীব কুমারকে। বুধবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সারদা মামলায় নাম জড়ানো রাজীবকে কেন রাজ্য পুলিশের শীর্ষ পদে বসানো হল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সরব হয়েছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। রাজীবের বিরুদ্ধে ঝুলে থাকা মামলা যাতে আবার সুপ্রিম কোর্টে ওঠে, তার ব্যবস্থা তিনি করবেন বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিরোধী দলনেতা। এ নিয়ে শুভেন্দুকে পাল্টা আক্রমণ করেছে শাসকদল তৃণমূলও। দলের মুখপাত্র শান্তনু সেন বলেন, ‘‘যাঁকে সারা দুনিয়া প্রকাশ্যে টাকা নিতে দেখেছে, যাঁর নাম সিবিআইয়ের এফআইআরে রয়েছে, যাঁর বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তাঁর মুখে এ সব কথা মানায় না।’’
সিবিআই সারদা মামলা হাতে নেওয়ার পর রাজীবের নাম জড়িয়েছিল তাতে। তার পর কখনও কলকাতা হাই কোর্টে, কখনও সুপ্রিম কোর্টে রাজীবের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তুলেছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। তার মধ্যে অন্যতম— তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করা। শুভেন্দু সেই অভিযোগকেই আবার টেনে এনেছেন। তাঁর দাবি, রাজীব সেই সময় সারদা মামলার একাধিক নথি নষ্ট করেছিলেন বলেই কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্তকারীরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি। বিরোধী দলনেতার আরও দাবি, রাজীবকে রাজ্য পুলিশের ডিজি করা হল তারই ‘রিটার্ন গিফ্ট’! শুভেন্দুর কথায়, ‘‘সারদার তথ্যপ্রমাণ নষ্ট করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এখনও বাইরে থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন রাজীব কুমার। তিনি তার প্রতিদান দিচ্ছেন।’’
এর পরেই রাজীব-মামলা ফের আদালতের নজরে আনার হুঁশিয়ারি দেন শুভেন্দু। তিনি বলেন, ‘‘সিবিআইকে বলব, সুপ্রিম কোর্টে মামলা কেন উঠছে না? সুপ্রিম কোর্টে মামলা পেন্ডিং আছে। এই মামলা তোলার ব্যবস্থা করুন। এই মামলা যাতে সুপ্রিম কোর্টে ওঠে, তার জন্য আমরা যা করার করব।’’
নিজের এক্স হ্যান্ডলের পোস্টেও শুভেন্দু লিখেছেন, রাজীবকে কলকাতা হাই কোর্ট অন্তর্বর্তী জামিন দিয়েছিল এই শর্তে যে, তিনি তদন্তে সব রকম সহযোগিতা করবেন। তা না হওয়ায় সিবিআই অন্তর্বর্তী জামিন প্রত্যাহারের আবেদন করেছিল সুপ্রিম কোর্টে। সেই মামলা শীর্ষ আদালতে এখনও ঝুলছে। শুভেন্দুর মন্তব্য, ‘‘যাঁর ভাবমূর্তি নিয়ে এত প্রশ্ন রয়েছে, তাঁকে রাজ্য পুলিশের শীর্ষ পদে বসানো সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক।’’ বিরোধী দলনেতার প্রশ্ন, ‘‘শীর্ষ আদালতের কোনও নির্দেশে যদি আইনি বিপাকে পড়েন ডিজি, তা কি রাজ্যের পক্ষে ভাল হবে?’’
২০১৩ সালের ১৮ এপ্রিল সারদা নিয়ে প্রথম মামলা রুজু করে বিধাননগর পুলিশ। তার ভিত্তিতে গ্রেফতার হন সুদীপ্ত সেন, দেবযানী মুখোপাধ্যায় এবং সারদার কয়েক জন কর্মী। এর পরেই রাজ্য পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল ‘সিট’ গঠন করে সারদা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেই সময় বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার হিসেবে সিট-এর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন রাজীব। পরবর্তী কালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা সংক্রান্ত সব মামলার তদন্তভার যায় সিবিআইয়ের হাতে। তদন্তে নেমে সিটের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ তুলেছিল কেন্দ্রীয় সংস্থা। তাদের দাবি ছিল, সারদা সংক্রান্ত নথির খোঁজ করলে সিট-এর দুই কর্তা তাঁদের বিধাননগরের ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স থানার একটি ঘরে পাঠিয়ে দেন। সেখানে স্তূপীকৃত নথি ঘাঁটতে সাত জন অফিসারের ২০ দিন সময় লেগেছিল।
আদালতে তদন্তকারী সংস্থার দাবি ছিল, সারদার তদন্ত করতে গঠিত সিটের দৈনন্দিন কাজকর্ম দেখাশোনা করতেন রাজীব। সে সময় সারদার অফিস বা নানা ঠিকানায় তল্লাশি চালিয়ে একটি ডায়েরি, ক্যাশ বুক উদ্ধার করেছিল সিট। তা সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেননি রাজীব। সিবিআই দাবি করেছিল, ওই ক্যাশবুক ও ডায়েরিতেই প্রভাবশালীদের কথা লেখা ছিল। সারদার অন্যতম পরিচালক দেবযানী ইডি ও সিবিআইকে জেরার সময় সমস্ত তথ্যাদি রাজীবকে তুলে দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। শিলংয়ের জেরা পর্বে দেবযানীর কণ্ঠস্বর শুনিয়ে রাজীবের কাছে জানতে চাওয়া হলেও তিনি তা স্বীকার করেননি বলে দাবি করেছিল কেন্দ্রীয় সংস্থা। তদন্তকারীদের আরও দাবি, সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে রাজ্যের কোন কোন প্রভাবশালীর যোগাযোগ ছিল, তাঁরা কার ফোন ব্যবহার করে কথাবার্তা চালাতেন, সবই জানতেন রাজীব।
সারদা মামলায় গ্রেফতারি এড়াতে রাজীব ‘নিরুদ্দেশ’ও হয়ে গিয়েছিলেন বলে দাবি করেছিল সিবিআই। শুভেন্দুর টুইটেও সেই প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। ঘটনাচক্রে, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজীবকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য তাঁর বাসভবনে গিয়েছিল সিবিআই। এর প্রতিবাদে ধর্মতলায় মেট্রো চ্যানেলে ধর্না দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যা নিয়ে সেই সময় তোলপাড় হয়েছিল রাজ্য রাজনীতি।
যদিও রাজীবের ঘনিষ্ঠ মহলের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা রাজনৈতিক কারণে তাঁকে হেনস্থা করতে চেয়েছিল। সারদা সংক্রান্ত সমস্ত নথিই তুলে দেওয়া হয়েছিল সিবিআইয়ের হাতে। কোনও ডায়েরি বা ক্যাশ বুক উদ্ধার হয়নি। তদন্তে সব রকম ভাবেই সাহায্য করা হয়েছিল সেই সময়।