আদালত চত্বর সুনসান। আইনজীবীদের বসার ঘরও ভোঁ ভোঁ। উধাও সাইকেল, মোটরবাইক কিংবা গাড়ির সেই চেনা ভিড়। শুধু দূরদুরান্ত থেকে বিচারপ্রার্থীরা এসে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন।
গত বেশ কয়েকদিন ধরে দফায় দফায় নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের বেশ কয়েকটি আদালতে কর্মবিরতি চলছে। কোনও আদালতের আইজীবীদের দাবি, দিনের পর দিন আদালতে মামলার পাহাড় জমছে। ভুক্তভোগী হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। তারই প্রতিবাদে তাঁদের এই সিদ্ধান্ত। কোনও আদালতের আইনজীবীরা আবার কোনও রাখঢাক না করেই জানান, প্রচণ্ড গরমে কাজ করা যাচ্ছে না। তাই এই কর্মবিরতি।
সাতসকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রোদে-গরমে দীর্ঘ পথ উজিয়ে আদালতে এসে হয়রান হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়া ক্ষুব্ধ বিচারপ্রার্থীদের কেউ কেউ বলছেন, ‘‘ও সব প্রতিবাদ লোক দেখানো। আসল কারণ, উকিলবাবুরা গরমে কাজ করতে পারছেন না। গরম শুধু ওঁদেরই লাগছে। আর বাকিরা যেন এই গরমে কাজ শিকেয় তুলে বসে আছে!’’
অত্যধিক গরমে বুধবার থেকে ফের তিন দিনের কর্মবিরতির সিদ্ধান্ত নেয় হাইকোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশন। এমন সিদ্ধান্তে আদালত যে ক্ষুব্ধ তা স্পষ্ট হয়ে যায় প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চের দুই বিচারপতির মন্তব্যেই। প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর প্রশ্ন করেন, ‘‘গরমে চিকিৎসক, নার্সরা কাজ করছেন না? তাঁদের কাজের জায়গা কি পুরোপুরি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত? স্কুলের বাচ্চাদের মতো আপনারা কেবল ছুটি চান কেন?’’ বেঞ্চের অন্য বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী আইনজীবীদের কাছে জানতে চান, ‘‘ট্রাফিক পুলিশ, ট্রাফিক সার্জেন্টরা রাস্তায় নেমে কাজ করছেন না?’’
এরপরেও কিন্তু টনক নড়েনি কারও। হাইকোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশনের পাশাপাশি জেলার বেশ কয়েকটি নিম্ন আদালতে কর্মবিরতি চলছেই। কান্দি আদালতে গত মঙ্গলবার থেকে শুক্রবার কর্মবিরতি পালন করেছেন আইনজীবীরা। তারপর মঙ্গলবার থেকে ফের চার দিনের কর্মবিরতির সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। বুধবার খড়গ্রামের পোড্ডা গ্রাম থেকে তফসিলি শংসাপত্রের জন্য হলফনামা জমা দিতে কান্দি আদালতে এসেছিলেন পেশায় দিনমজুর অজিত বাগদি। আদালতে কোনও কাজ না হওয়ায় তাঁকে ফিরে যেতে হয়। অজিতবাবু বলেন, ‘‘গত শুক্রবারেও এসে ফিরে গিয়েছিলাম। আজও ফিরে যেতে হচ্ছে। আদালত ছাড়া যেন আর কোথাও গরম পড়ছে না।’’ কাঠফাটা রোদে গোদাগ্রাম থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার পথ উজিয়ে কান্দি আদালতে এসেছিলেন মাঝবয়সী জালালউদ্দিন। তিনি বলছেন, ‘‘পারিবারিক একটা সমস্যার বিষয়ে আইনি পরামর্শ নিতে আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করব বলে এসেছিলাম। কিন্তু সে আর হল কই? শুধু শুধু যাতায়াত বাবদ এতগুলো টাকা খরচ হয়ে গেল।’’
কান্দি বার অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে বিকাশ রঞ্জন দে ও সফিউর রহমান বলেন, “এতে কাজের একটু ক্ষতি হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু কর্মবিরতি পালন না করে উপায়ও ছিল না।’’ তাঁদের যুক্তি, গত সোমবার এক দলিল লেখক কাজ করার সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে হাসপাতালেও ভর্তি করাতে হয়। ফলে এমন সিদ্ধান্ত না নিলে হয়তো আরও বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত।
কান্দি আদালতের আইনজীবী সনাতন স্বর্ণকার বলেন, “আইনজীবীদের তো মাথা ঠান্ডা করে কাজ করতে হয়। কিন্তু এই গরমে সেটা করা সম্ভব হচ্ছে না বলেই কর্মবিরতি পালন করা হচ্ছে।’’ কান্দির মহকুমাশাসক বিজিন কৃষ্ণ বলেন, “গরমের সময় তো গরম লাগবেই। তাই বলে কর্মবিরতির বিষয়টি মানা যায় না।”
গত ২৬ মে থেকে দফায় দফায় কর্মবিরতি চলছে জঙ্গিপুর আদালতেও। সেখানকার আইনজীবীরা অবশ্য গরমের বিষয়টি মানতে নারাজ। তাঁদের ব্যাখ্যা, জঙ্গিপুর আদালতে মামলার পাহাড় জমছে। কিন্তু তার কোনও কিনারা হচ্ছে না। আর এই বিপুল সংখ্যক মামলার নিষ্পত্তি না হওয়ায় ভুক্তভোগী হচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা। তারই প্রতিবাদে এই কর্মবিরতি। আজ, বৃহস্পতিবার ফের আইনজীবীদের বৈঠকে বসার কথা। সেখানেই ঠিক হবে এরপরে ফের কর্মবিরতি চলবে কি না। কিন্তু এই কর্মবিরতিতে বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি তো আরও বাড়ল। কমল না মামলার পাহাড়ও। সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বার অ্যাসোসিয়েশনের তরফে অবশ্য কোনও সদুত্তর মেলেনি।
নবদ্বীপ আদালতেও চলছে আইনজীবীদের কর্মবিরতি। সৌজন্যে সেই গরম। বার অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গিয়েছে, সোমবার ৮ জুন থেকে এক সপ্তাহের জন্য কর্মবিরতি পালন করছেন আইনজীবীরা। গত ১৮ মে থেকে টানা কর্মবিরতি চলছে রানাঘাট আদালতেও। রানাঘাট বার অ্যাসোসিশনের সম্পাদক মিলন সরকার জানান, এই আদালতে বহু মামলা জমে রয়েছে। নেই বসার জায়গা, পানীয় জল ও শৌচাগারের ব্যবস্থা। তাই বিচারপ্রার্থীদের কথা ভেবেই তাঁদের এই কর্মবিরতি।
আর যাঁদের কথা ভেবে আইনজীবীদের এমন সিদ্ধান্ত সেই বিচারপ্রার্থীদের অনেকেই কিন্তু বলছেন, ‘‘উকিলবাবুরা গরমের ছুটি কাটানোর জন্য ভাল অজুহাত পেয়ে গিয়েছেন। আমাদের জন্য এত কিছু না ভেবে ওঁরা আদালতে এলে আমাদের হয়রানির পাশাপাশি অর্থ ও সময় দুটোই বাঁচত।’’
কিন্তু এই কথাটা বলার জন্যও বিচারপ্রার্থীদের এখন চুপ করে থাকতে হবে। কর্মবিরতি চলছে যে!
ছবি: গৌতম প্রামাণিক ও কল্লোল প্রামাণিক।