ডিএ মামলায় নজর সুপ্রিম কোর্টেই। ফাইল চিত্র।
অনমনীয়তায় কোন পক্ষ বেশি দৃঢ়, ডিএ বা মহার্ঘ ভাতাকে ঘিরে সেটাই বাংলায় বড় কৌতূহলের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘোষণা অনুযায়ী তিন শতাংশের বেশি ডিএ দেওয়া তাঁর সরকারের সাধ্যাতীত বলে নবান্নের অনড় মনোভাব স্পষ্ট করে দিয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্য দিকে, বকেয়া ডিএ-র দাবিতে আন্দোলনের ঝাঁঝ বাড়িয়ে চলেছে বিভিন্ন কর্মচারী সংগঠন। এই অবস্থায় ১৫ মার্চ ডিএ-র ভবিষ্যৎ চূড়ান্ত হয়ে যেতে পারে সুপ্রিম কোর্টে। তবে আর্থিক ও প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের অভিমত, শেষ পর্যন্ত কর্মীদের ডিএ-র দাবি পূরণ হলে ‘যত্র আয় তত্র ব্যয়’-এর রাজ্যে অপরিমেয় আর্থিক বোঝা চাপবে সরকারের ঘাড়ে। নিকট ও অদূর ভবিষ্যতে সেই বোঝা সামলানো বড় চ্যালেঞ্জ হবে নবান্নের কাছে।
নতুন অর্থবর্ষের (২০২৩-২৪) বাজেটে সরকার দেখিয়েছে, রাজ্যের আয় হতে পারে ৩.১০ লক্ষ কোটি টাকা। খরচ হবে তার চেয়ে সামান্য কিছু বেশি। তাতে রাজস্ব ঘাটতি থাকতে পারে প্রায় ৩১ হাজার কোটি, যা পৌঁছতে পারে ৬৬ হাজার কোটিতে। চলতি অর্থবর্ষের (২০২২-২৩ সংশোধিত বাজেট) থেকে তা প্রায় চার হাজার কোটি টাকা বেশি।
মুখ্যমন্ত্রী গত ৭ মার্চ বিধানসভায় বলেছিলেন, “এর থেকে বেশি (ডিএ) দেওয়া সম্ভব নয়। পছন্দ না-হলে আমার মাথা কেটে নিয়ে যান।”
অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞেরা জানান, ২০২০ সালে ষষ্ঠ বেতন কমিশনের সুপারিশ রূপায়ণের আগে এক কিস্তি ডিএ দিতে খরচ হত মাসে প্রায় ২৫ কোটি টাকা। সেই সুপারিশ রূপায়ণের পরে কর্মচারীদের মূল বেতন ২.৫৭ গুণ বেড়েছে। সে-দিক থেকে এখন ওই এক কিস্তি ডিএ দিতে সরকারের খরচ হওয়ার কথা মাসে প্রায় ৬৪ কোটি টাকা, বছরে ৭৬৮ কোটি। রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের দাবি, ডিএ-র প্রশ্নে কেন্দ্রের থেকে রাজ্যের কর্মীরা এখন ৩২% পিছিয়ে রয়েছেন। ফলে সেই পরিমাণ ডিএ মিটিয়ে দিতে হলে সরকারের খরচ হতে পারে বছরে ২৪৫৭৬ কোটি টাকার মতো। এক অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ বলেন, “এরিয়ার (বকেয়া পাওনা) ধরলে টাকার অঙ্ক পৌঁছে যেতে পারে ৫০ থেকে ৬০ হাজার কোটিতে।”
ডিএ নিয়ে অন্যতম মামলাকারী সংগঠন কনফেডারেশন অব স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ়ের সাধারণ সম্পাদক মলয় মুখোপাধ্যায়ের দাবি, “২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি কর্মচারীদের ডিএ হওয়ার কথা ছিল ১২৫%। সেটা হয়েছে ২০১৯ সালে। ডিএ-র এক-একটা কিস্তি ১৮, ২৪, ৩০, এমনকি ৫৪ মাস পরে মিটিয়েছে সরকার। এই অবস্থায় পঞ্চম বেতন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বকেয়া ডিএ নিয়ে চলা মামলার রায়ের দিকে তাকিয়ে আছি আমরা।”
সরকারকে শেষ পর্যন্ত ডিএ দিতে হলে টাকা আসবে কোথা থেকে? অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, মূল সামাজিক অনুদান প্রকল্পগুলির সম্মিলিত খরচ এখন বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। তাঁদের দাবি, তাতে কাটছাঁট করা মুশকিল রাজনৈতিক কারণেই। নতুন বছরে ঋণ শোধে সরকারকে ধরে রাখতে হবে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা। বেতন খাতে সরকার ধরে রেখেছে প্রায় ৬৪ হাজার ৫৩৩ কোটি। এ বছরের তুলনায় তা প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা বেশি। পেনশন খাতেও ধরতে হচ্ছে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা। আছে অন্যান্য সামাজিক প্রকল্প, প্রশাসনিক দৈনন্দিন খরচ এবং দফতর-ভিত্তিক বরাদ্দ। নয়া অর্থবর্ষে রাজকোষ ঘাটতি ৩.৮৩ শতাংশে বেঁধে রাখতে হবে। ফলে চলতি বছরের তুলনায় কিছুটা কম ঋণ করতে পারবে। এক অর্থকর্তা বলেন, “ডিএ বাড়লে কর্মীদের বেতনও বাড়বে। তার খরচের বিপুল বোঝা চাপবে সরকারের ঘাড়ে। তা হলে সামাজিক প্রকল্পগুলিতেও কাটছাঁট না-করলে সামলানো মুশকিল।”
আইন, অর্থনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা জানাচ্ছেন, কিস্তিতে বা প্রভিডেন্ট ফান্ডের মাধ্যমে বকেয়া মেটালে অবশ্য বড় ধাক্কা লাগবে না। ভবিষ্যতে খরচের খুব মেপে পা ফেলতে হবে সরকারকে।