ঢিল ছোড়া দূরত্বে থানা ও পুরসভা। অথচ অভিযুক্তকে ধরতে পারছে না পুলিশ। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
বোলপুর থানা থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়। সেখানে ঢোকার মুখে দলের লোকেদের কড়া পাহারা। দোতলায় দলের যুব সংগঠন, কলেজে কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচন নিয়ে জোর চলছে। আর পাঁচটা দিনের মতো সোমবারও সেখানে তখন হাজির বীরভূম জেলা যুব তৃণমূলের সভাপতি সুদীপ্ত ঘোষ। গত বুধবার রাতে বোলপুর থানায় ঢুকে পুলিশ নিগ্রহের ঘটনায় যিনি মূল অভিযুক্ত। তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর-ও হয়েছে। কিন্তু এ দিনও তাঁর হাতে হাতকড়া পরানো সম্ভব হয়নি পুলিশের পক্ষে।
শুধু সুদীপ্তই নয়, এফআইআর-এ নাম রয়েছে, এমন আরও ন’জনকেও দলীয় বৈঠকে এ দিন উপস্থিত থাকতে দেখা গিয়েছে বলে দলীয় সূত্রের খবর। দোতলায় কে কে যাচ্ছে, তার উপরে যেমন নীচের পাহারাদার দলীয় কর্মীদের নজর ছিল, তেমনই দোতলার অফিস ঘরে বসে দলীয় দফতরে কোথায় কী ঘটছে, তা সিসিটিভি-র মনিটরে চোখ রেখে তা বুঝে নিচ্ছিলেন সুদীপ্ত। শুধু এ দিনই নয়, দলীয় কর্মীরা বলছেন, সিসিটিভি-র মনিটরে চোখ রেখে রোজই এ ভাবে সব কিছু নিয়ন্ত্রণে রাখেন সুদীপ্ত। দলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের সঙ্গে কারা দেখা করতে পারবেন, সেই চাবিকাঠিও রয়েছে সুদীপ্তর জিম্মায়।
তৃণমূল কার্যালয়ের সামনে এ দিন ছিল সংবাদমাধ্যমের ভিড়। কিন্তু দো’তলায় ওঠা তো দূর, দলীয় কর্মীরা একতলাতেই ভিড় করতে দিচ্ছিলেন না। সাফ জানিয়ে দিচ্ছিলেন, “দলের জরুরি বৈঠক হচ্ছে। সেখানে সুদীপ্তবাবু নেই।”
কিন্তু সিঁড়ির কাছ থেকে পরিষ্কার গলা পাওয়া যাচ্ছিল সুদীপ্তর। হঠাৎই দেখা যায়, সাদা হাফ স্লিভ জামা আর কালো প্যান্ট পরিহিত সুদীপ্ত একবার উপরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হাতে একটি ফাইল নিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে ঢুকে গেলেন। ওই একবারই মাত্র দেখা গেল তাঁকে।
এ দিকে অন্যান্য দিনের মতো এ দিনও ভোর সাড়ে পাঁচটায় বোলপুর পুরসভার দরজা খুলেছিল। সুদীপ্তবাবু যে হেতু বোলপুর পুরসভার স্যানিটারি ইন্সপেক্টর, তাই তাঁর কাজ শুরু হয় সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে। রোজ বেলা এগারোটা পর্যন্ত তিনি থাকেন পুরসভায়। তার পরে যান পার্টি অফিস। দুপুরে খাওয়ার জন্য একবার বাড়ি। ফের বিকেলে পার্টি অফিস। এটাই সুদীপ্তর দৈনিক কর্মতালিকা। এ দিন সকাল থেকে অবশ্য সুদীপ্তকে পুরসভায় পাওয়া যায়নি। যদিও তাঁর ঘর খোলা ছিল। কিছু ক্ষণ পরে তা বন্ধ করে দেন কর্মীরা।
বোলপুর পুরসভার তৃণমূল পুরপ্রধান সুশান্ত ভকতও এ দিন অনুপস্থিত ছিলেন। তাঁকে টেলিফোনে ধরা হলে পুরপ্রধান বলেন, “আমি অসুস্থ। আমি নিজেই যখন অনুপস্থিত, কী ভাবে বলব কে এসেছে আর কে আসেনি?” এর পরেই ফোন কেটে দেন তিনি। পরে ফের তাঁকে ফোনে ধরা হলে সুশান্ত বলেন, “একটা অসুস্থ লোককে কেন বারে বারে বিরক্ত করছেন?”
দলীয় সূত্রের খবর, এ দিন বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ নিজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে দলীয় কার্যালয়ে যান সুদীপ্ত ঘোষ। তার আগে অবশ্য দলীয় দফতরে ঢুকে পড়েছেন তাঁর অন্য সঙ্গীরা। দলীয় অফিসের গায়ে লাগানো বোলপুর থানার পুলিশ অবশ্য সুদীপ্ত ও তাঁর সঙ্গীদের দেখতে পায়নি। কেন পুলিশ অভিযুক্তদের নাগালে পেয়েও ধরছে না? জেলার পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়ার ফোন বেজে বেজে কেটে গিয়েছে। কেন এফআইআরে নাম থাকা এক জনকেও গ্রেফতার করা যাচ্ছে না, সেই প্রশ্নের জবাব মেলেনি জেলার ছোট-বড় কোনও পুলিশ কর্তার কাছ থেকেই। বোলপুর থানার ওসি প্রশ্নের জবাব দিতে চাননি। আর বোলপুরের এসডিপিও সূর্যপ্রতাপ যাদব কোন মন্তব্য না করে নিজের গাড়িতে উঠে যান।
পুলিশ বা জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের কোনও হেলদোল না থাকলে হবে, রাজনৈতিক ভাবে সুদীপ্তকে গ্রেফতারের দাবি উঠে গিয়েছে। রবিবার বোলপুর থানায় বোলপুর শহর কংগ্রেস সুদীপ্ত ঘোষ এবং অন্য অভিযুক্তদের ধরার দাবিতে স্মারকলিপি দিয়েছিল। এ দিন কংগ্রেসের শ্রমিক সংগঠনের নেতা তপন সাহা বলেন, “নিজেদের দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতেও যদি পুলিশ অভিযুক্তদের ধরতে না পারে, তা হলে আইনশৃঙ্খলার রইলটা কি?”
পুলিশের নিচুতলা এখন আশঙ্কা করছে, জেলা তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল সার্টিফিকেট দেওয়ার পরে সুদীপ্তকে পাকড়াও করা এখন অত্যন্ত কঠিন। উল্টে তাঁরা এখন তাঁদের আবাসনে হামলার আশঙ্কা করছেন প্রতি মুহূর্তে। মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়া যাঁদের কাজ, তাঁরাই এখন নিরাপত্তা খুঁজছেন।