ঝড়ের দাপটে উড়ে গিয়েছে চাল। অশোকনগরে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
সাগরে দানা বেঁধে আছে অতিগভীর নিম্নচাপ। প্রবল বৃষ্টিকে সঙ্গী করে তা আছড়ে পড়ার ভয় রয়েছেই। তার আগেই দক্ষিণবঙ্গের কয়েকটি এলাকাকে আচমকা নাড়িয়ে দিয়ে গেল ‘টর্নেডো’-র মতো মিনিটখানেকের ঝড়। যা মানুষকে তুলে নিয়ে ফেলল অনেকটা দূরে। শেকড়শুদ্ধ উপড়ে গেল বিশাল বট গাছ। গাছের গুঁড়ি চিরে গেল মাঝামাঝি! যেমনটা দেখা গিয়েছিল সুনামির পরে, আন্দামানে।
উত্তর ২৪ পরগনার হাবরা বা হাওড়ার পাঁচলার ওই ধ্বংসাত্মক ঝড় টর্নেডো কি না, তা বুঝতে আবহবিজ্ঞানীদের একটি দল আজ বৃহস্পতিবার হাবরা যাবে। তবে আবহবিদদের চিন্তা বঙ্গোপসাগরের অতি গভীর নিম্নচাপটিকে ঘিরে। সর্বশেষ ছবি বলছে, কলকাতা থেকে ৩৪০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে এটি। আজ, বৃহস্পতিবার বিকেলে ওই ঝড় বাংলাদেশ উপকূলে ঢুকে পড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আলিপুর হাওয়া অফিস। যা দক্ষিণবঙ্গে নিয়ে আসতে পারে দুর্যোগ। এই পূর্বাভাসের ভিত্তিতে গোটা দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে সতর্কতা জারি করেছে নবান্ন।
বৃহস্পতিবার যে ঝড়টি আছড়ে পড়ার আশঙ্কা, তার শক্তি কতটা হতে পারে, এ ব্যাপারে একমত নন আবহবিজ্ঞানীরা। বিদেশের বিভিন্ন আবহাওয়া পূর্বাভাস সংস্থা জানাচ্ছে, ওই অতিগভীর নিম্নচাপটি স্থলভূমিতে ঢোকার আগে ঘূর্ণিঝড়ের চেহারা নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে ঝড়ের গতিবেগ হবে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটারের উপরে। আলিপুর হাওয়া অফিস বলছে, অতিগভীর নিম্নচাপটি উপকূলের এত কাছাকাছি থাকায় সেটির ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরিত হওয়ার আশঙ্কা কম। অতিগভীর নিম্নচাপ হিসেবে স্থলভূমিতে ঢুকলে বাতাসের গতিবেগ হবে ঘণ্টায় ৫০-৬০ কিলোমিটার। ঝড়ের চেহারা যা-ই হোক না কেন, দক্ষিণবঙ্গে প্রবল থেকে অতিপ্রবল বৃষ্টি হবে, এমন পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছে দেশি-বিদেশি সব আবহাওয়া সংস্থাই।
বঙ্গোপসাগরে এই নিম্নচাপটি তৈরি হওয়ার পর থেকেই আবহবিদদের ভোগাচ্ছে। তিন দিন ঠায় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে সেটা যেমন শক্তি বাড়িয়েছে, তেমনই কোথা দিয়ে ও কখন, কেমন চেহারা নিয়ে তা স্থলভূমিতে ঢুকবে, সেটা বুঝতে দেয়নি। বুধবার সকালেই গভীর নিম্নচাপটি অতিগভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়ে ধীরে ধীরে তার অবস্থান বদলাতে শুরু করে। সকাল ১০টায় তার দূরত্ব ছিল কলকাতা থেকে ৩০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে। কিন্তু তা এমন ভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে, যা চিন্তা বাড়িয়েছে আবহবিদদের। রাত আটটায় দেখা যায়, কলকাতা থেকে তার দূরত্ব বেড়ে হয়েছে ৩৪০ কিলোমিটার। রাতেও স্পষ্ট হয়নি, ঘুরপাক খেতে খেতে ঠিক কখন কোথা দিয়ে সে স্থলভূমিতে ঢুকবে। ‘রহস্যময়’ এই নিম্নচাপটি স্থলভূমিতে ঢুকে কী কী ঘটাবে, তা নিয়েও সন্দেহে আবহবিদরা। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ বলেন, ‘‘আজ, বৃহস্পতিবার বিকেলে বাংলাদেশ উপকূল হয়ে স্থলভূমিতে ঢুকতে পারে অতিগভীর নিম্নচাপটি। স্থলে ঢুকেই তার অভিমুখ বদলে যেতে পারে। ঝড়বৃষ্টি ধেয়ে আসতে পারে দক্ষিণবঙ্গের দিকে। বিষয়টি আমরা রাজ্য সরকারকে জানিয়েছি।’’ এই সতর্কতা পেয়ে এ দিন সন্ধেয় তড়িঘড়ি বৈঠকে বসেন স্বরাষ্ট্রসচিব-সহ রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষকর্তারা।
দুর্যোগের এই পূর্বাভাসের মধ্যেই মঙ্গলবার বিকেলে হাওড়ার পাঁচলায় এবং বুধবার দুপুরে উত্তর ২৪ পরগনার হাবরায় হানা দেওয়া দু’টি ঝড় হাওয়া অফিসের সব হিসেব গুলিয়ে দিয়েছে। পাঁচলায় বেশ কিছু বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপড়ে পড়েছে গাছ। তবে হাবরার ঝড়ে স্থায়িত্ব তুলনায় কম হলেও তা ছিল বেশি ধ্বংসাত্মক। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সওয়া এগারোটা নাগাদ হঠাৎই আকাশ কালো করে ঝড় শুরু হয়। কিন্তু তাতেই গোটা এলাকা কার্যত তছনছ হয়ে যায়। হাবরা পুর এলাকায় ১০০টি কাঁচা বাড়ি ভেঙে পড়েছে। ২৫ জন আহত হয়েছেন। উত্তর ২৪ জেলা প্রশাসন ওই ঝড়কে টর্নেডো বললেও, আলিপুর আবহাওয়া দফতর কিন্তু সমীক্ষার আগে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত কিছু বলতে রাজি নয়।
আবহবিদদের কেউ কেউ বলছেন, ‘‘অতিগভীর নিম্নচাপের ফলে বাতাসের গতিবেগে একটা পরিবর্তন এসেছে। নিম্নচাপের কেন্দ্র থেকে ৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা জুড়ে ছোট ছোট ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হচ্ছে। আর তা থেকে একাধিক মেঘপুঞ্জ তৈরি হয়েছে। মালার মতো তা ছড়িয়ে রয়েছে নদিয়া, বর্ধমান, উত্তর ২৪ পরগনা ও মুর্শিদাবাদ জেলার আকাশে। সেখানেও এই ধরনের ঝড় বয়ে যেতে পারে।’’ মঙ্গলবার পাঁচলায় এবং এ দিন হাবরার ঝড়ের পিছনেও তেমনই কোনও ঘূর্ণাবর্ত এবং মেঘপুঞ্জের হাত রয়েছে বলে মনে করছেন আবহবিদদের অনেকে।
এক আবহবিদ বলেন, ‘‘এ দিন বর্ধমানের নির্দিষ্ট একটি এলাকা জুড়ে প্রবল বৃষ্টির খবর পেয়েছি আমরা। তার পিছনেও ওই হঠাৎ তৈরি হওয়া ঘূর্ণাবর্ত ও মেঘপুঞ্জ।’’
গোকুলবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘ওই ঘূর্ণাবর্তের ফলে কোথাও কোথাও উল্লম্ব (খাড়া থাম বা ফানেলের মতো) মেঘ তৈরি হয়। তার ফলে ওই এলাকার উপর দিয়ে বিধ্বংসী ঝড় বয়ে যেতে পারে। অনেক সময় এই ধরনের ঝড় টর্নেডোর চেহারা নেয়।’’ তিনি জানান, হাবরাতেও ঝড় টর্নেডোর রূপ নিয়েছিল কি না, সেটা বুঝতেই বৃহস্পতিবার বিজ্ঞানীরা সেখানে যাবেন।
তবে সামগ্রিক ভাবে পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে উপকূলের দিকে ধেয়ে আসা অতিগভীর নিম্নচাপটিকে নিয়ে। দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় এ দিন দুপুরের পর থেকেই প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তার ফলে বহু এলাকাতেই বানভাসি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর জানিয়েছে, বুধবার জলে ডুবে ও সাপের কামড়ে ৫ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে। মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২। দশ হাজার বাড়ি ও সাড়ে তিন লক্ষেরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। হাওড়া, পুরুলিয়া, বর্ধমান, দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও বাঁকুড়া সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এর মধ্যেই আশঙ্কা বাড়িয়েছে শুক্রবারের ভরা কোটাল। তাতে সমুদ্র এবং নদীর জল ফুলেফেঁপে উঠতে পারে। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার নদীবাঁধ রক্ষায় বিশেষ সতকর্তা জারি করেছে নবান্ন।
দুর্যোগ মোকাবিলায় এ দিন তড়িঘড়ি বৈঠক ডেকেছিলেন প্রশাসনিক কর্তারা। জনস্বাস্থ্য কারিগরি, স্বাস্থ্য, সেচ, বিপর্যয় মোকাবিলা, মৎস্য ও বিদ্যুৎ দফতর এবং সংশ্লিষ্ট জেলার জেলাশাসকদের নিয়ে ভিডিও কনফারেন্স করেন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে তিনি জানান, বৃহস্পতিবার বিকেলে নিম্নচাপের কারণে দুর্যোগ শুরু হওয়ার কথা। ভারী বৃষ্টি এবং ভরা কোটাল, দু’টি একসঙ্গে হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।