বাড়িতে পড়ার টেবিলে শীর্ষেন্দু শীল। ছবি: সন্দীপ পাল।
মগজাস্ত্রে তার দু’বার আঘাত এসেছে। রক্তনালী ফেটে রক্তক্ষরণ হয়েছে। দু’বারই অস্ত্রোপচার করতে হয়েছিল মস্তিষ্কে। প্রথমবার তেইশ দিন থাকতে হয়েছে ভেন্টিলেশনে। সে বারে বেঁচে ফিরে আসার পরে এক দিক অসাড় হয়ে পড়ে, মাস ছয়েকের জন্য। তবু অদম্য ছেলেটি। টানা চোদ্দো মাস বিভিন্ন হাসপাতালে কাটিয়েও শেষ পর্যন্ত একাদশ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা দিতে কেন্দ্রে পৌঁছতে পেরেছিল সে। লাঠি হাতে। এবং সেই পরীক্ষার সময়েই দেখা গিয়েছে, এত আঘাতেও মগজাস্ত্রে ধার কমেনি তার।
সেই শীর্ষেন্দু শীল এ বারে আইএসসি পাশ করল ৯৯ শতাংশ নম্বর পেয়ে। এখন তার পাখির চোখ সর্বভারতীয় মেডিক্যাল প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে চিকিৎসক হওয়া।
শীর্ষেন্দুর লড়াইটা শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে। জলপাইগুড়ি শহরের বর্ধিত মোহন্তপাড়ায় থাকে সে। পড়ত শহরের হোলিচাইল্ড স্কুলে। আইসিএসই পরীক্ষায় ৯৫ শতাংশ নম্বর পেয়েছিল সে। সেই পরীক্ষার ফল হাতে আসার আগেই সে অঙ্ক, ইংরেজি ও বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে সব মিলিয়ে ১৪টি স্বর্ণপদক পেয়েছিল। কিন্তু তার মধ্যেই দেখা দিয়েছিল দুর্যোগের লক্ষণও। বাড়ি থেকে বলা হচ্ছে, আইসিএসই পরীক্ষার আগেই শীর্ষেন্দুর মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়। এক দিন জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। নার্সিংহোমে ভর্তিও থাকতে হয়। তবে সে বারে মেডিক্যাল পরীক্ষায় কিছু ধরা পড়েনি। আইসিএসই পরীক্ষার দিন পনেরো আগে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে।
শীর্ষেন্দুর বাবা সুকুমার বলছিলেন, একাদশ শ্রেণিতে পড়াকালীন ২০১৮ সালের নভেম্বরে হঠাৎ ফের প্রবল মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়। প্রথমে সে ভর্তি হয় জলপাইগুড়ি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে। সেখান থেকে শিলিগুড়ির তিনটি নার্সিংহোম ঘুরে ভর্তি হয় শিলিগুড়ির স্নায়ু চিকিৎসা কেন্দ্রে। তখন সে ভেন্টিলেশনে চলে গিয়েছে। এই ভাবেই কাটে তেইশটা দিন। শীর্ষেন্দুর বাবা-মা দুজনেই স্কুল শিক্ষক। বাবা বলেন, “শীর্ষেন্দুর মস্তিকের একটি রক্তনালী ফেটে যায়। মাথায় অস্ত্রোপচার করতে হয়। অস্ত্রোপচারের টেবিল থেকে যখন ও হাসপাতালের শয্যায় ফেরে, শরীরের একটা দিক অসাড় হয়ে গিয়েছে।’’ এর পরে ছ’মাস ধরে ফিজিয়োথেরাপি করার পরে স্বাভাবিক জীবনে ফেরে শীর্ষেন্দু।
যন্ত্রণার কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ছ’মাস পরে শীল পরিবার যখন মনে করছে সঙ্কট কেটে গিয়েছে, ২০১৯ সালের মে মাসে আবার ব্যথা শুরু হয় শীর্ষেন্দুর মাথায়। আবার পরীক্ষা করে ধরা পড়ে, মস্তিষ্কের আরও একটি রক্তনালী স্বাভাবিক ভাবে কাজ করতে পারছে না। শীর্ষেন্দুর মা, জলপাইগুড়ি সেন্ট্রাল গার্লসের শিক্ষিকা নীলিমা জানান, আবার মাথায় অস্ত্রোপচার হয় ছেলের। এ বারে বেঙ্গালুরুতে। তাঁর কথায়, “এখনও দিনে কড়া মাত্রার ওষুধ খেতে হয় ওকে। বেশি ক্ষণ জেগে থাকতে পারে না। তবে যত ক্ষণ জেগে থাকে, বই পড়ে।”
এর পরেও তাকে থামানো যায়নি। এ বছর বাড়িতে বসে অনলাইনে পরীক্ষা দিয়ে সে অঙ্ক ও ইংরেজি অলিম্পিয়াডে ফের সোনার পদক জিতেছে। করোনা আবহে অনলাইনে উচ্চ মাধ্যমিক টেস্ট পরীক্ষাও দিয়েছে। এবং আইএসসি-র চূড়ান্ত নম্বরের মতো সেই টেস্ট পরীক্ষাতেও পেয়েছে ৯৯ শতাংশ নম্বর।
এখন অনেকটাই সুস্থ শীর্ষেন্দু। তার কথায়, ‘‘চিকিৎসকেরা বলেছেন, ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে যাব। করোনার সময় দেখলাম, কী ভাবে লড়াই করছেন ওঁরা। আমিও একটা লড়াই শেষ করলাম। তাই আমারও ইচ্ছে চিকিৎসক হওয়ার।’’