শক্ত হাতে: রসুলপুর নদীর খাঁড়িতে নৌকা নিয়ে মাছের খোঁজে আলপনা ও কল্পনা। ছবি: শুভেন্দু কামিলা।
কুনমা যাউটু রে?
—এই খানিক নদীক পানে।
ভোর তখনও জাগেনি। মায়ের কোলের কাছে ঘুমে কাদা দুই বোন। এক জন দশ, অন্যটা পাঁচে পড়েছে। বাপ-কাকাদের হাঁকডাকে ঘুমনোর জো কই! পুব কোণ রাঙা হওয়ার আগেই সে যেন যজ্ঞিবাড়ি। হট্টগোলে কচি মেয়ের স্বপন-সুতো ভোকাট্টা।
মেয়েবেলার স্মৃতি-সফরে ঠোক্কর খান কল্পনা আর আলপনা। আশৈশব জোড়াতালির জীবন, নেই আর নেইয়ের লম্বা তালিকাই দেখেছেন দু’জনে। ছ’ভাইবোনের মধ্যে শেষের এই দুই বোন পিঠোপিঠি। চেহারাতেও ভারী মিল। গাঁয়ের লোকে বলত লক্ষ্মী-সরস্বতী। কিন্তু তাদের না ছিল ইস্কুলে যাওয়া, না গান-বাজনা, ছবি আঁকা, না সামনে কোনও আলোকরেখা। দিদি-বোনের মনে হয়, বরং এই মাঝবয়সে এসেই জীবনপ্রবাহ অনেক অনায়াস। কারণ, তার হাল এখন পুরোপুরি তাঁদের নিজেদের হাতে। ওই ঘাটে বাঁধা নৌকাখানের মতোই।
নদী আর নাওয়ের সঙ্গে জন্মইস্তক জীবন জুড়েছে দুই বোনের। ঘর তাঁদের খেজুরির বোগা গ্রামে। অদূরে রসুলপুর নদী। বাবা বরেন্দ্রনাথ বর ছিলেন মৎস্যজীবী। তাঁর হাত ধরেই জাল বোনা, নৌকার দাঁড় টানা আর মৎস্য শিকারে হাতেখড়ি। কল্পনা ও আলপনার লেখাপড়া এগোয়নি। তবে মাছ ধরার খুঁটিনাটি সব হাতের মুঠোয়।
“হবে না কেন! পাঁচ-সাত বচ্ছর বয়স থেকেই তো বাপের সঙ্গে জুতে যেতাম দুই বোনে। কাঠিতে আড়জাল বোনা, জলে জাল ফেলা, তার পরে মাছ উঠলে টেনে তোলা— সব শিখেছি একটু একটু করে।”— বলছিলেন কল্পনা। বয়স পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই। চেহারায় ভারিক্কি ভাব। চুলেও পাক ধরেছে। তবে পেটানো গড়ন আর হাত দু’খানি কঠিন, দৃঢ়। ২৮ বছর আগে বাবার মৃত্যুর পরে জীবন-নাওয়ের হাল ধরা পোক্ত সেই হাত।
মধ্য চল্লিশের আলপনা তুলনায় বেশ ছটফটে। কথাবার্তাতেও অনর্গল। এ যে উন্মনা কিশোরী? দুষ্টু হাসি খেলে যায় মাঝবয়সিনীর। ঠোঁট চেপে জবাব আসে, “আমাদের কিশোরীবেলা কাটল কই! বুড়িয়ে গেলাম। তবু দু’বোনের আইবুড়ো দশা কাটল না।” তা নিয়ে অবশ্য বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই। মাটির দেওয়াল আর টালির ছাদের ঘেরাটোপে গেরস্থালি সামলানোর ফাঁকে তাঁরা বললেন, “সংসার মানেই বুঝি বিয়ে-থা আর বাচ্চাকাচ্চা? এই যে আমরা দু’টিতে থাকি, আনাজ কাটা, ভাত রান্না, কাপড় নিঙড়ানো— কোন কাজটা নেই বলো তো! এ বুঝি সংসারধম্ম নয়!” তার উপরে রয়েছে নিত্য নৌকা বেয়ে রসুলপুর নদীতে
জাল ফেলা। তার পরে রুলি, ভোলা, দইচাক, চিংড়ি, লটেমাছ উঠলে সোজা বোগা বাজারে গিয়ে বেচা।
পাঁচ বছর হল গত হয়েছেন মা কুসুমবালা। ছেলেদেরসংসারে নয়, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন দুই মেয়ের জিম্মাতেই। কল্পনা বললেন, “মা চলে যাওয়ার পরে ঘরটা বড্ড ফাঁকা লাগে। আমরা দুই বোনে তো রাত থাকতেই নদীতে বেরিয়ে পড়ি। তার পরে দিনভরটো টো। মা-ই ঘরদোর আগলে রাখতেন।”
ঘরের দশা অবশ্য এ বার বর্ষার পরে বেশ সঙ্গিন। ক’জায়গায় টালি ভেঙেছে। জল পড়ছে হড়হড়িয়ে। কাঁচা দেওয়ালও নড়বড়ে। সরকারের লোকজন ভাঙা ঘরের ছবি তুলে নিয়ে গিয়েছে বার কতক। ওই অব্দিই। আর কেউ রা কাড়েনি। এ বার ভারী বৃষ্টির পরে পঞ্চায়েত থেকেত্রিপলও জোটেনি।
তাতে কী! হাত দু’খানা আছে তো। এখন মরা কটালে ক’দিন নৌকা ভিড়বে না। তাই ভাঙা ঘর নিজেরাই সারিয়ে নিচ্ছেন দুই বোনে। আলপনা বলছিলেন, “অন্যের ভরসায় থাকলে চলবে না কি! এখন পুজো আসছে। সব তাতেই মেতে।”
গাঁয়ে পুজো হয় তো। যান না?
এ বার সবাক কল্পনা, “দশমী পর্যন্ত নৌকাও বেরোয় না। পুজোতেই থাকি। মা-কে অঞ্জলি দিই। চাওয়া একটাই, শেষ বয়স পর্যন্ত হাত দু’টোয় যেন জোর থাকে।”
আর নতুন শাড়ি? প্রৌঢ়ার স্বর এ বার নিশ্চল, “আমাদের ও সব নেই বাপু। সেই বাচ্চাকালেও কেউ পুজোয় একটা নতুন ফ্রক কিনে দেয়নি। এখন আর ইচ্ছেও করে না। শাড়ি ছিঁড়লে তবে কিনি।”
ঘুপচি ঘরের কাঁচা দেওয়ালে ছেঁড়াখোঁড়া ক্যালেন্ডার। পুরু ধুলোয় সালঙ্কারা সিংবাহিনীর সাজ বিবর্ণ। তবে সে আঁধারেও দীপ্যমানদশভুজের তেজ।