আরাধনা: নিজের বাড়িতে পুজোয় বসেছেন জয়া চক্রবর্তী। ছবি: সন্দীপ পাল
নামাবলি জড়িয়ে মণ্ডপের দিকে চলেছেন বৃদ্ধ। সঙ্গে সঙ্গে চলেছে ছোট্ট একটি মেয়ে। ফুল ছাপা ফ্রক পরা। দু’দিকে বিনুনি। চলতে চলতে ছিঁড়ে নিচ্ছে পুকুর পাড়ে ফুটে থাকা কাশফুল, উড়িয়ে দিচ্ছে দুব্বো ঘাসে বসে থাকা ঘাসফড়িং। মণ্ডপে পৌঁছে পুজোয় বসেন বৃদ্ধ ঠাকুরদা। তাঁর পাশে চুপটি করে বসে থাকে নাতনি। দুর্গার ত্রিশূলের খোঁচায় রক্ত গড়িয়ে অসুরের বুকেই শুকিয়ে গিয়েছে। কিন্তু অসুরের চোখে জল কই! অসুরেরা কি কাঁদে না? ঠাকুরদার কাছেই এ সব প্রশ্ন করা যায়। তিনি বলেন, ‘‘সকলেই কাঁদে। কেউ সামনে, কেউ আড়ালে। অসুরও কাঁদে।’’
মেয়েটিও কেঁদেছিল খুব। যে দিন বাড়ির উঠোনে বাঁশের মাচা পাতা হয়েছিল। ঘরের বিছানা থেকে ঠাকুরদাকে পাঁজাকোলা করে তুলে এনে শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল বাঁশের মাচায়। সেই মাচা কাঁধে তুলে ওরা মাঠের দিকে চলে গিয়েছিল পুকুর পাড়ের রাস্তা ধরেই। সেই শরতেও ফুটেছিল কাশফুল।
তার পরে কত দিন সেই পথে মেয়েটি খুঁজতে গিয়েছিল ঠাকুরদাকে। সে ছায়া-রাস্তায় ঘাসের ফাঁকে ঠোঁট ঢুকিয়ে কী যেন খুঁটে খায় ঘুঘু পাখি। তার শব্দেও উড়ে যায় না।
শরৎকাল এলেই ছায়াচ্ছন্ন রাস্তায় ঠাকুরদাকে খোঁজে মেয়েটি। যে দিন বরের কাছে বেদম বকুনি খেয়েছিল, সে দিনও খুঁজেছিল। স্নান সেরে বেরিয়ে ভেজা চুল পিঠে ফেলে কপালে টিপ আঁকতে আঁকতে আয়নায় নিজের সঙ্গে দেখেছিল বরের ছায়াও। সে-ও এক আশ্বিন। বরও পুরোহিত। মণ্ডপে যাবে, দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবে সে দিন। তাই বরের তাড়াহুড়ো। আয়নায় পড়া বরের মুখের ছায়ার দিকে তাকিয়ে মেয়েটি জিজ্ঞেস করেছিল, “আমি যে তোমার জন্য সিঁদুর পরি, শাঁখা পরি, তুমি কেন আমার জন্য কিছু পরবে না?” স্বামী উত্তরে বলেছিল, “রাখো তো এ সব! এ তো সমাজের নিয়ম, মানতে হয়।” নিয়ম! যন্ত্রণায় বিদ্ধ হলে কারও চোখ থেকে নিজে নিজেই অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ে, সে-ও তো নিয়ম।
কিন্তু অসুরের চোখে জল কই!
ভেজা চুল থেকে জলবিন্দু গড়িয়ে নামতে থাকে মেয়েটির চিবুক ছুঁয়ে। আয়নায় স্পষ্ট দেখা যায় বিন্দু বিন্দু জল। সে আয়নায় তখন শুধু তার একারই ছায়া।
মা তো শিখিয়েছেন, যে নিয়মকে প্রশ্ন করে উত্তর মেলে না, সে নিয়মের সঙ্গে লড়তে হয়। সেই তিন বছর আগে যখন প্রথম দুর্গাপুজো করতে বসেছিল মেয়েটি, সে-ও তো নিয়মের সঙ্গে লড়াই। মেয়ে পুজো করছে শুনে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল লোকজন। পিছন থেকে কথা ছুড়ে দিয়েছিল: “মেয়েমানুষের পুজো ঠাকুর নেবেই না!” গায়ে এসে বিঁধেছিল কথা। ধুনুচির ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করেছিল। মেয়েটি যজ্ঞের কাঠ ভাঙতে ভাঙতে দেবীর মুখে চেয়েছিল, “পুজো নেবে না? কেন নেবে না? নিয়ম ভেঙেছি বলে?” ভাঙা নিয়মের অজস্র টুকরো যে মেয়ের সারা শরীরে গেঁথে আছে, চুলে আটকে গিয়েছে, আঁখিপল্লবে ঘুমিয়ে আছে। বয়সে বড় অনেকে বলেছিল, অশুচি হয়ে ঠাকুর ঘরে ঢুকতে নেই। সে বারণ শোনেনি সে। দেবীর চোখের দিকে তাকায় মেয়েটি, “মা, অশুচি কী করে হয়?” মাটির মা উত্তর দেয় না, শুধু চোখে হাসি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। উত্তর দিয়েছিলেন চিন্ময়ী মা। বলেছিলেন, “শরীরেরও প্রকৃতি আছে। সেই প্রকৃতির নিয়মে কেউ অশুচি কেন হবে?”
এই নিয়ে তিন বার পুজো হল। প্রতি বারই পুজোয় বসে ঘোর লাগে মেয়ের। প্রথমে কিছুতেই মুখ দিয়ে মন্ত্র বের হতে চায় না। কেউ যেন এসে গলা টিপে ধরে। কে? ওই যারা বারবার বলেছিল, বিয়ের দশ বছর হল, মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাও না কেন? মা অবশ্য বলতেন, ‘‘আগে বিএ করুক, এমএ করুক। তার পরে বিএড। তার পরে শ্বশুরবাড়ি।’’
মেয়ে এখন হাই স্কুলের শিক্ষক। এই স্কুলেই তো পুজোর শুরু। বসন্তের গোড়ায় সে বারে স্কুলের বাংলা দিদিমণি ডেকে বলেছিলেন, “জয়া, তুই-ই এ বার স্কুলে সরস্বতী পুজো করবি।” সে পুজো দেখতে গোটা গ্রাম হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। তার পরেই তো ডাক পড়ল দুর্গাপুজো করার। পুরোহিত বর বলেছিল, “দুর্গাপুজো করবে। এসো, তোমাকে পৈতে দিয়ে দিই।” তবু পুজোয় বসলে প্রথমে গলা বুজে আসে! ভয়ে ছেড়েই দিতে চেয়েছিল পুজো। তার পরে প্রতিমার দিকে তাকালে চোখে পড়ে, সে মুখে হাসি লেগে আছে। ত্রিশূল বিদ্ধ হয়েও অসুরের চোখে জল নেই। শক্তি পায় মেয়ে। গড়গড় করে মন্ত্রোচ্চারণ করে সে। কোথা থেকে আসে শক্তি? মাটির প্রতিমার হাসি থেকে, নাকি রক্তাক্ত অসুরের অশ্রুহীন চোখ থেকে?
সে কথা জানেন না জলপাইগুড়ির ধাপগঞ্জের জয়া চক্রবর্তী। শ্বশুরবাড়ির পদবী অধিকারী। জলপাইগুড়ি বিবেকানন্দ হাইস্কুলের শিক্ষিকা জয়া বাপের বাড়ির উপাধিই লেখেন। গোত্রান্তর মানেন না। প্রশ্ন করলে হেসে বলেন, “খুব ইচ্ছে আছে বিয়েতে পুরোহিত হব। তবে আমার শর্তে হবে সে বিয়ে। কন্যাদান, গোত্রান্তর— এ সব অকারণ নিয়ম মোটেই করাব না।’’ কবে হবে এমন বিয়ে? মেয়ে বলেন, “অপেক্ষায় থাকি।”