কিন্তু অনেক দিন ওষুধপত্রের সরবরাহ ঠিক না-থাকায় লোকাল পারচেজের টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে প্রায় সব হাসপাতালেই। কোভিডও এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিয়েছে। সরকার কোভিড ফান্ডে টাকা দিয়ে জানিয়েছে, তা দিয়ে কোনও ওষুধ কেনা যাবে না।
প্রতীকী ছবি।
টাকা নয়, ছায়া-টাকা। ‘শ্যাডো ফান্ড’। অনেকটা বাচ্চাদের পুতুল খেলার মিছিমিছি ভাত-ডালের মতো। সরকার মুখে বলে দিচ্ছে, অমুক হাসপাতালকে এত কোটি টাকা দেওয়া হল। কিন্তু সেটা শুধু কাগজে-কলমেই। সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল সেই টাকা হাতে পাচ্ছে না। কবে যে পাবে, তারও কোনও ঠিক নেই। এটাকেই সরকারি পরিভাষায় বলে ‘শ্যাডো ফান্ড’। কিন্তু সেই ছায়া-টাকায় যেমন পেট ভরে না, ওষুধও মেলে না। সব হাসপাতালের তহবিলের অবস্থা তাই শোচনীয়। বাধ্য হয়েই ওষুধ নিয়ন্ত্রণের পথে হাঁটছে শহর ও জেলার অনেক হাসপাতাল।
সরকারি হাসপাতালে সব ওষুধই ‘ফ্রি’। কিন্তু টাকার অভাবে সরকারই যদি ওষুধ কিনতে না-পারে, সাধারণ মানুষ নিখরচায় তা কী করে পাবে, সেই প্রশ্ন বড় হয়ে উঠছে। অবস্থার অবনতি জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকেই। কোনও হাসপাতালে ১০ লক্ষ, কোথাও আট লক্ষ, কোথাও দু’লক্ষ টাকা পড়ে আছে। অথচ মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ওষুধ এবং চিকিৎসাসামগ্রী খাতে প্রতি মাসে খরচ হয় কম করে তিন থেকে চার কোটি টাকা। জেলা হাসপাতালে এই খরচের পরিমাণ মাসে গড়ে এক কোটি। জেলা হাসপাতালের তহবিলে কোথাও এক লক্ষ টাকা পড়ে আছে, কোথাও বা রয়েছে মাত্র ৭০ হাজার।
স্বাভাবিক ভাবেই বহু জায়গায় ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী কেনা প্রায় বন্ধ। কিছু হাসপাতালে কার্ডিয়াক, অর্থোপেডিক সার্জারি আটকে রয়েছে। ফলে প্রায় সর্বত্রই ক্যানসার, ডায়াবেটিস, গ্যাসট্রোএন্টেরোলজির ওষুধ, অ্যান্টাসিড, অ্যান্টিবায়োটিক, বমি ও রক্তচাপের ওষুধ, এমনকি প্যারাসিটামলের আকাল তীব্র হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কিছু হাসপাতাল বহির্বিভাগ এবং জরুরি বিভাগ থেকে দেওয়া ওষুধের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে বাধ্য হয়েছে।
এর মধ্যে গত ১০ ফেব্রুয়ারি রাজ্য সরকার হাসপাতালগুলির জন্য কিছু টাকা বরাদ্দ করেছে বটে, কিন্তু তাতে কোনও কাজই হয়নি। কারণ, সেটা ‘শ্যাডো ফান্ড’! একটি মেডিক্যাল কলেজের সুপার বললেন, ‘‘এই মিছিমিছি টাকায় সরবরাহকারীরা ওষুধ দেবেন কেন? ফলে সরকারি হাসপাতালগুলির হাতে আপাতত রয়েছে শুধুই পেনসিল!’’
অর্থাভাবের কথা স্বীকার করে স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী বলেন, ‘‘কেন্দ্র জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের টাকা দিতে অসম্ভব দেরি করছে। এই দেরির কারণেই আমাদের তহবিলে টাকার সমস্যা হচ্ছে।’’ কিন্তু কেন্দ্র তো কিছু দিন আগে জানিয়েছিল, ২০২০-২১ অর্থবর্ষে জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনে পশ্চিমবঙ্গকে দেওয়া ১৮৯৫ কোটি টাকার মধ্যে রাজ্য ৮৮৩ কোটি টাকা খরচই করতে পারেনি! স্বাস্থ্য অধিকর্তার অভিযোগ, ‘‘ওরা টাকার একটা বড় অংশ পাঠায় অর্থবর্ষ শেষ হওয়ার ঠিক মুখে, দেরি করে। তখন টাকা খরচ হবে কী করে!’’
এই টানাপড়েনের মধ্যে পড়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে যেমন এই মুহূর্তে অ্যান্টিবায়োটিক, ক্যানসার, গ্যাস, ডায়াবিটিসের ওষুধ, ল্যাবরেটরি ডায়াগনস্টিক কিটের ভান্ডার কার্যত শূন্য। আরজি কর হাসপাতালের কার্ডিয়োলজি বিভাগে যত ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রীর প্রয়োজন হচ্ছে, মিলছে তার মাত্র ৫০-৬০ শতাংশ। নীলরতন হাসপাতালে গত সপ্তাহেও ক্যানসার ও হৃদ্রোগের ওষুধের মজুত ছিল তলানিতে। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে ওষুধের টানাটানির জন্য ৪ ফেব্রুয়ারি কর্তৃপক্ষ নোটিস দিয়ে বলেছেন, কোনও চিকিৎসক জরুরি বিভাগ থেকে তিন দিনের এবং বহির্বিভাগ থেকে সাত দিনের বেশি ওষুধ লিখতে পারবেন না। এত দিন ওই দুই বিভাগ থেকে এক বা দু’মাসের ওষুধ দেওয়া হত। হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, নিয়ন্ত্রণ না-করলে সকলকে ওষুধ দেওয়া যাবে না।
হাসপাতালে জরুরি ভিত্তিতে ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী অনেক সময় ‘লোকাল পারচেজ’ বা স্থানীয় ভাবেও কেনা হয়। সেটা কি করা যাচ্ছে? অধিকাংশ হাসপাতাল জানিয়েছে, সরকারি নিয়মবিধি অনুযায়ী ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রীর জন্য প্রদত্ত অর্থের ২০ শতাংশ স্থানীয় কেনাকাটায় ব্যবহার করা যায়। কিন্তু অনেক দিন ওষুধপত্রের সরবরাহ ঠিক না-থাকায় লোকাল পারচেজের টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে প্রায় সব হাসপাতালেই। কোভিডও এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিয়েছে। সরকার কোভিড ফান্ডে টাকা দিয়ে জানিয়েছে, তা দিয়ে কোনও ওষুধ কেনা যাবে না। শুধু অক্সিজেন ও চিকিৎসাসামগ্রী কেনা যাবে। কিন্তু অনেক কোভিড রোগীরই জরুরি ভিত্তিতে ওষুধ লেগেছে। তখন বাধ্য হয়ে সেই ওষুধ কিনতে হয়েছে লোকাল পারচেজের টাকা দিয়ে। তাতে টাকা ফুরিয়ে গিয়েছে।
কবে টাকা আসবে এবং কাটবে ওষুধের সঙ্কট? সদুত্তর মিলছে না।