উপেন-কথিত রঞ্জন আদতে বাগদার মামাভাগিনা গ্রামের বাসিন্দা চন্দন মণ্ডল। নিজস্ব চিত্র।
শিক্ষক-নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে রঞ্জন-বোমাটি প্রথম ফাটিয়েছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা সিবিআইয়ের প্রাক্তন যুগ্ম অধিকর্তা উপেন বিশ্বাস। এ বার প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগ প্রসঙ্গে মামলায় আদালতে উঠে এল উপেনের ইউটিউব ভিডিয়োর সেই রঞ্জন-প্রসঙ্গ। তবে এখন স্বনামেই চিহ্নিত রঞ্জন। আইনজীবীরা হাই কোর্টে জানিয়েছেন, উপেন-কথিত রঞ্জন আদতে বাগদার মামাভাগিনা গ্রামের বাসিন্দা চন্দন মণ্ডল।
বুধবার এই মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। মামলায় উপেনকেও যুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁকে তদন্তে সহযোগিতা করতে বলেছে কোর্ট। ১৫ জুন এ ব্যাপারে কোর্টে প্রাথমিক রিপোর্ট দিতে হবে সিবিআইকে। প্রয়োজনে চন্দনকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে জেরা করতে পারবে সিবিআই, জানিয়েছে আদালত।
সৌমেন নন্দী নামে এক চাকরিপ্রার্থী প্রাথমিকে নিয়োগ-কেলেঙ্কারি নিয়ে মামলা করেছিলেন। সৌমেনের আইনজীবী ফিরদৌস শামিম বুধবার জানান, ৮৭ জনকে বেআইনি ভাবে নিয়োগ করা হয়েছে। সেই মামলাতেই চন্দনের নাম উঠে এসেছে। আদালতকে ধন্যবাদ জানিয়ে এদিন সংবাদমাধ্যমে উপেন বলেন, ‘‘আমি আদালতকে সাহায্য করব। যদি দেখি, সিবিআই ঠিকমতো কাজ করছে না, তা হলে তা-ও আদালতকে জানাব। আমি ছাড়ব না।’’
এ দিকে, চন্দনের বাড়ি বুধবারও ছিল তালাবন্ধ। বেশ কিছু দিন ধরেই তাঁকে এলাকায় দেখা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন পাড়া-পড়শিরা। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগও করা যায়নি।
চন্দন-চর্চা
• উত্তর ২৪ পরগনার বাগদার বাসিন্দা চন্দন মণ্ডল। প্রাথমিক স্কুলের প্যারাটিচার।
• টাকা নিয়ে বহু লোককে স্কুলের চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ।
• চন্দনকে নিয়ে বছরখানেক আগে একটি ভিডিয়ো-বার্তা দিয়েছিলেন প্রাক্তন মন্ত্রী তথা সিবিআইয়ের প্রাক্তন যুগ্ম অধিকর্তা উপেন বিশ্বাস।
• ভিডিয়োয় চন্দনের নাম জানাননি তিনি। জানিয়েছেন, চাকরি দিতে না পারলে টাকা ফেরত দিতেন রঞ্জন। এলাকার লোক তাঁকে সৎ বলেই মানেন। এ কারণে ভিডিয়োর নাম ‘রঞ্জন সৎ’।
বছরখানেক আগে ‘রঞ্জন সৎ’ নামে একটি ইউটিউব ভিডিয়োয় উপেন দাবি করেন, উত্তর ২৪ পরগনার বাগদার জনৈক রঞ্জন টাকা নিয়ে বহু লোককে স্কুলের চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন। গোপনীয়তার স্বার্থে রঞ্জনের আসল নাম জানাননি তিনি। সে সময়ে রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে সিবিআই। তারই মধ্যে উপেনের ভিডিয়ো ঘিরে শোরগোল পড়ে। কিন্তু তাঁর রঞ্জনই কি চন্দন? উপেন এ দিন বলেন, ‘‘না, বলব না। তবে আমার নায়ক বা খলনায়ক রঞ্জন। ওর পেটে অনেক তথ্য আছে।’’
২০১৪ সালে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতা মান নির্ধারক পরীক্ষা (প্রাইমারি টেট) হয়েছিল। যে ৮৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা ওই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হয়েই চাকরি পেয়েছেন বলে ফিরদৌস কোর্টে অভিযোগ করেন। প্রাথমিক নিয়ে কলকাতা হাই কোর্টে আরও দু’টি জনস্বার্থ মামলা হয়েছে। তার মধ্যে একটি মামলার আবেদনকারী হুগলি জেলার বাসিন্দা। আদালত সূত্রের খবর, তিনি নিজে টেট উত্তীর্ণ হতে পারেননি। তবে মামলার আবেদনপত্রে নথি দিয়ে দেখিয়েছেন, টেট অনুত্তীর্ণ দুই তরুণীকে ২০১৭ সালে সিঙ্গুরের দু’টি প্রাথমিক স্কুলে নিয়োগ করা হয়েছিল।
ইউটিউব ভিডিয়োয় উপেন দাবি করেছিলেন, এলাকায় লোকে রঞ্জনকে ‘সৎ’ বলে মানেন। কারণ, তিনি নাকি টাকা নিয়ে চাকরি দেননি, এমনটা হয়নি। চাকরি না দিতে পারলে সুদ-সহ টাকা ফিরিয়ে দিয়েছেন, এমন উদাহরণও আছে। তিনি ‘গোপনীয়তার স্বার্থে’ রঞ্জনের আসল নাম ভিডিয়োয় না জানালেও দিন কয়েক আগে বনগাঁ দক্ষিণের বিজেপি বিধায়ক স্বপন মজুমদার বলেছিলেন, ‘‘বাগদায় এক চন্দন আছেন। শুনেছি টাকার বিনিময়ে তিনি ১৭০০ লোককে চাকরি দিয়েছেন।’’ বনগাঁ উত্তর কেন্দ্রের বিজেপি বিধায়ক অশোক কীর্তনীয়াও দিন কয়েক আগে চন্দনের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। বুধবার তিনি বলেন, ‘‘হাই কোর্ট সিবিআইকে বলেছে, চন্দন মণ্ডলকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে। এতে রাজ্যের সেই সব যোগ্য প্রার্থীদের সুরাহা হবে, যাঁরা চাকরি পাননি।’’
ভিডিয়োয় উপেন দাবি করেছিলেন, প্রাথমিকে ১০ লক্ষ, উচ্চ প্রাথমিকে ১৫ লক্ষ, হাইস্কুলের চাকরি ১৮-২০ লক্ষ টাকায় পাইয়ে দিতেন রঞ্জন। এলাকায় গিয়ে জানা গিয়েছে, লক্ষ লক্ষ টাকা তাঁর হাত দিয়ে আদানপ্রদান হলেও রঞ্জন ওরফে চন্দনের জীবন ছিল সাদামাঠা। স্কুটিতে ঘুরতেন। বাড়িঘরও বিশাল কিছু নয়। তবে সকাল থেকে বাড়ির সামনে ভিড় লেগে থাকত। স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকের দাবি, তাঁর হয়ে একাধিক ‘এজেন্ট’ ইদানীং ‘কাজ’ করছিল এলাকায়। গত কয়েক বছরে তাদেরও আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছিল।
সিবিআই তদন্তের নির্দেশকে স্বাগত জানিয়ে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী এ দিন বলেন, ‘‘প্রকৃত নাম না বলে উপেন বিশ্বাস গোটা ঘটনা আগেই জানিয়েছিলেন। তখন রাজ্য সরকার তদন্ত করেনি কেন? এখন আদালত যে নির্দেশ দিয়েছে, সেটা ইতিবাচক পদক্ষেপ। রাজ্যের বাকি মন্ত্রীদের যা অবস্থা, উপেন বিশ্বাস তেমন ছিলেন না। তিনি নীতি নিয়ে চলেন, আমরা বরাবর বলেছি। তিনি সহযোগিতা করলে দুর্নীতির শিকড়ে পৌঁছনো যাবে বলে সকলেরই বিশ্বাস।’’
উপেন এক সময়ে ছিলেন তৃণমূলের মন্ত্রী। সেই দলের জাতীয় কর্মসমিতির সদস্য তথা বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এ দিন কোনও মন্তব্য করতে চাননি। আগেই কেন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা করেনি পুলিশ, তা নিয়ে জেলার পুলিশের কোনও আধিকারিকও মন্তব্য করতে চাননি।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।