জমি ছাড়তে চেয়ে বন্দরকে লেখা ভেঙ্কটেশের আইনজীবীর চিঠি।
কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে তাদের জামি ফেরত দেওয়ার কথা সোমবার। তার দু’দিন আগে আজ, শনিবারই দখল করে রাখা জমি বন্দর কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিচ্ছে ভেঙ্কটেশ ফিল্মস।
কলকাতা বন্দরের এস্টেট ম্যানেজার শুভ্রকমল ধরের কাছে শুক্রবার চিঠি পাঠিয়ে জমি হস্তান্তরের কথা জানিয়ে দিয়েছেন ভেঙ্কটেশের আইনজীবী সঞ্জয় বসু। তিনি লিখেছেন, ‘ওই জমি ফেরত দিতে আমাদের প্রতিনিধি শনিবার বেলা ১২টায় হাজির থাকবেন। আপনাদের লোক যেন সেখানে থাকে’।
সঞ্জয়বাবু এ দিন ফোনে বলেন, ‘‘আমার মক্কেল পরিস্থিতির শিকার। যে সংস্থার থেকে জমিটি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল, তাদের যে ভাড়া দেওয়ার এক্তিয়ারই নেই, সে কথা জমি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হওয়ার পরে জেনেছি।’’ বন্দরের এস্টেট ম্যানেজারের অবশ্য বক্তব্য, ‘‘খোঁজখবর না নিয়ে কোনও সংস্থা ১০০ কাঠা জমি ভাড়া নেবে, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবে জবরদখলকারী সংস্থার চিঠি পেয়েছি। জমি হাতে পেলে আদালতকে তা জানিয়ে দেব।’’
তারাতলার পি-৫১ হাইড রোডে কলকাতা বন্দরের ওই ১০০ কাঠা জমি মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহধন্য চলচ্চিত্র প্রযোজক শ্রীকান্ত মোহতার সংস্থা ভেঙ্কটেশ ফিল্মস জবরদখল করে রেখেছে বলে অভিযোগ ছিল। এই নিয়ে বিতর্কের মাঝেই জমি ছেড়ে দেওয়ার জন্য বন্দরের কাছে ৩ মাস সময় চেয়ে চিঠি দেয় ভেঙ্কটেশ। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয়, অবিলম্বে ওই ছবি ছাড়তে হবে তাদের। হাইকোর্টে মামলা চলাকালীন ভেঙ্কটেশ জমিটি ছেড়ে দেওয়ার জন্য দু’মাস সময় চাইলেও বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত তাদের ১৬ নভেম্বরের মধ্যে ওই জমি ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। সেই মতো জমি হস্তান্তর-পর্ব মিটিয়ে আগামী সোমবার বন্দর ও ভেঙ্কটেশ উভয়পক্ষেরই আদালতের কাছে রিপোর্ট পেশ করার কথা। তার আগেই আসল মালিকের হাতে জমি ফিরিয়ে দিতে বন্দরকে চিঠি দিল ভেঙ্কটেশ।
তারাতলার এই জমি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দু’পক্ষের লড়াই চলছিল। বন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি ছিল, পি-৫১-এর ওই ১০০ কাঠা জমি গত তিন বছর ধরে বেআইনি ভাবে দখল করে পাঁচটি স্টুডিও চালাচ্ছিলেন শ্রীকান্তবাবু। ওই জমি থেকে বছরে ন্যূনতম ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা ভাড়া পাওয়ার কথা। কিন্তু তাদের এক পয়সাও দেয়নি শ্রীকান্তের সংস্থা। সেই কারণেই আদালতের নির্দেশ নিয়ে গত ১৩ সেপ্টেম্বর অন্তত ৫০ কোটি টাকা মূল্যের ওই জমির
দখল নিতে গিয়েছিলেন বন্দর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সে দিন প্রবল বাধার মুখে পড়ে ফিরতে হয় তাঁদের। অভিযোগ ওঠে, দখলকারীদের লোকজন রীতিমতো মারধর করে তাণ্ডব চালিয়ে বন্দরের লোকজনদের বের করে দেয়। ওই ঘটনার পর বন্দর কর্তৃপক্ষ স্থির করেন, তাঁরা পুলিশের সাহায্য নিয়ে ওই জমি উদ্ধার করতে যাবে।
বন্দরের এক কর্তার কথায়, ‘‘১৩ সেপ্টেম্বর মার খেয়ে ফিরে আসার পর জমি উদ্ধার করতে সাহায্য চেয়ে লালবাজারকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। তাতে ওরা সাড়া দেয়নি। মুখ্যমন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ হাইপ্রোফাইল ওই ব্যবসায়ীর জমির দখল নিতে পুলিশ আগ্রহী ছিল না। তাই হাইকোর্টে যেতে হয়েছে।’’
বন্দর-কর্তাদের অভিযোগ, পুলিশের এ ধরনের অসহযোগিতার নজির ওটাই প্রথম নয়। ওই জমি উদ্ধার করতে সাহায্য চেয়ে গত দেড় বছরে স্থানীয় পুলিশকে অন্তত আধ ডজন চিঠি দেওয়া হয়েছিল। এই নিয়ে তারাতলা থানার সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনাও করেছিলেন বন্দর-কর্তারা। অন্তত তিন বার উচ্ছেদের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করে
পুলিশ কমিশনারের হস্তক্ষেপও চাওয়া হয়। কিন্তু প্রতিবারই কোনও না কোনও কারণ দেখিয়ে ওই জমি উচ্ছেদে রাজি হননি লালবাজারের কর্তারা। বন্দরের এক কর্তার কথায়, ‘‘শ্রীকান্তের সংস্থা যে বেআইনি ভাবে জমি দখল করে ওখানে পাঁচ-পাঁচটি স্টুডিও চালাচ্ছে, তার হাঁড়ির খবর জানত পুলিশ। কিন্তু নবান্নের ছায়ায় লালিত বলেই ওই প্রযোজক সংস্থার গায়ে আঁচড় কাটার সাহস দেখায়নি তারা!’’
বন্দরের ওই জমি কী ভাবে দখলে নিল মোহতার সংস্থা?
১৯৬৯ সালে পি-৫১ হাইড রোডের প্রায় ১৮৫ কাঠা জমি অ্যাভারি ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড নামে একটি ওজন যন্ত্র নির্মাতা সংস্থাকে লিজ দিয়েছিল কলকাতা বন্দর। বার্ষিক ভাড়ার চুক্তিতে ৩০ বছরের লিজে এই জমি দেওয়া হয়। ১৯৯৯ সালে অ্যাভারির লিজ চুক্তি শেষ হয়ে যায়। জমির দখল
নিতে ২০০০ সালে ‘দ্য পাবলিক প্রেমিসেস’ (এভিকশন অফ আনঅথরাইজড অকুপ্যান্টস)-১৯৭১ আইনে মামলা করেন বন্দর কর্তারা। ওই সময় আদালতে হাজির হয় এলএমজে কনস্ট্রাকশন নামে একটি সংস্থা। এই সংস্থাটি আদালতের কাছে লিজ নবীকরণের দাবি করে। মামলা চলে এগারো বছর। ২০১১ সালের ৭ মার্চ কলকাতা বন্দরের এস্টেট অফিসার ওই জমি থেকে সমস্ত জবরদখলকারীকে সরিয়ে দিতে বলেন।
বন্দরের দাবি, ২০১২ সালের জুন মাস নাগাদ তারা জানতে পারে সেখানে নতুন করে বেআইনি নির্মাণ শুরু করে প্রায় ১০০ কাঠা জমি নিজেদের দখলে নিয়েছে ভেঙ্কটেশ ফিল্মস। এলএমজে-র কাছ থেকে তারা ওই জমি ভাড়ায় নিয়েছে। ভেঙ্কটেশকে হটাতে বহু বার চেষ্টা করেও শেষমেশ ব্যর্থই হতে হয়েছে বন্দর কর্তাদের। তাঁদের একাংশ মনে করেন, পুলিশ সাহায্য করেনি বলেই দীর্ঘদিন জমির দখল নিতে পারেননি তাঁরা। যদিও ভেঙ্কটেশের আইনজীবীর বক্তব্য, ‘‘আমার মক্কেলের সঙ্গে প্রতারণা হয়েছে। এলএমজে-র কথা বিশ্বাস করে চুক্তি করে ঠকেছেন ওঁরা। তাই এলএমজে-র বিরুদ্ধেও ফৌজদারি ধারায় মামলা করা হয়েছে।’’
এলএমজে-র প্রতিনিধি গৌতম মুখোপাধ্যায় এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে বন্দরের অন্য এক কর্তার কথায়, ‘‘আমাদের কাছে ভেঙ্কটেশ এবং এলএমজে দু’টিই জবরদখলকারী সংস্থা। ভেঙ্কটেশের মতো এলএমজে-কেও জবরদখল করে রাখা বাকি ৮৫ কাঠা জমি ছেড়ে দিতে হবে।’’