ভাঙা ট্যাঙ্কের সামনে ভিড়। বৃহস্পতিবার। ছবি: শুভেন্দু তন্তুবায়
নিম্ন মানের মশলার ব্যবহার না নকশায় ত্রুটি, শ্রমিকদের দক্ষতার অভাব, না মাটিতে কোনও সমস্যা—২৪ ঘণ্টা কাটলেও বাঁকুড়ার সারেঙ্গায় জলের রিজ়ার্ভার ভাঙার কারণ স্পষ্ট হল না। কারণ খুঁজতে জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরের চিফ ইঞ্জিনিয়ার মৌসিন আলি খানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি বৃহস্পতিবার দুপুরে ফতেডাঙার ধ্বংসস্তূপ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে। ভেঙে পড়া রিজ়ার্ভারের অবশিষ্ট দেওয়াল ঠুকে করা হয় মজবুতি পরীক্ষা। কিন্তু কেন ভাঙল রিজ়ার্ভার তা নিয়ে মুখ খোলেননি কমিটির সদস্যেরা। শুধু বলেন, “আমরা নমুনা সংগ্রহ করেছি। পরীক্ষা করে দেখব।’’
তবে নির্মাণ সামগ্রীর ওই নমুনা কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগারে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে পরীক্ষার দাবি তুলেছেন বাঁকুড়ার বিজেপি সাংসদ সুভাষ সরকার। এ দিন ধংসস্তূপ দেখতে গিয়ে তাঁর অভিযোগ, ‘‘নিম্ন মানের রড ও পাথর ব্যবহার করা হয়েছিল। সিমেন্ট, বালির মিশ্রণও ঠিক ছিল না। নির্মাণ এতটাই দুর্বল, যে হাতে নিয়ে অল্প চাপ দিলেই ভেঙে যাচ্ছে! নিরপেক্ষ ভাবে তদন্ত করা উচিত।’’ রাজ্যের জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরের মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র বলেন, ‘‘নিরপেক্ষ তদন্ত হচ্ছে। ২৬-২৭ জানুয়ারির মধ্যে প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট দিতে বলেছি। তদন্তে যে স্তরের দোষই ধরা পড়ুক না কেন, দোষীরা ছাড় পাবে না।’’
রিজ়ার্ভারে জল ভরার দায়িত্বে থাকা ‘অপারেটর’ সাগুন মুর্মুর দাবি, বুধবার বেলা সাড়ে ১২টার সময় জল ভরতে গিয়ে তিনি ‘কড়-কড়’ করে শব্দ শুনতে পান। তাঁর কথায়, ‘‘ট্যাঙ্ক হেলে পড়ছে বলে মনে হচ্ছিল। তাই জল ভরা শেষ করেই দ্রুত বেরিয়ে ঠিকা সংস্থার কর্মীদের ফোনে খবর দিই। ওরা আমাকে ওখান থেকে সরে যেতে বলে। দেখতে দেখতে ২৫ মিটারের ট্যাঙ্ক মাটিতে মিশে গেল!’’
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, নানা কারণে এমন বিপত্তি ঘটতে পারে। নকশায় ত্রুটি, অদক্ষ শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো যার অন্যতম। নির্মাণ সামগ্রী থেকে মাটির গুণগত মানও খুঁটিয়ে দেখা দরকার। যদিও জেলা জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি দফতরের আধিকারিকদের একাংশ দাবি করছেন, নির্মাণকাজের সময়ে দফতর থেকে নিয়মিত নজরদারি চালানো হত। পরিকল্পনামাফিক নির্মাণসামগ্রী দেওয়া হচ্ছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হয়। নির্মাণের আগে মাটি পরীক্ষাও করা হয়েছিল। তাতে কোনও ত্রুটি ধরা পড়েনি। এমনকি, কাজ চলাকালীন দফতরের পর্যবেক্ষণেও সমস্যা নজরে আসেনি।
নির্মাণকারী সংস্থাই এখনও ২০১৬ সালে তৈরি হওয়া ওই রিজ়ার্ভারের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে। ওই সংস্থার এক আধিকারিক দাবি করেন, ‘‘নির্মাণ কাজে কোথাও গলদ ছিল না। তিন বছর ধরে (উদ্বোধন ২০১৭) ওই রিজ়ার্ভার পুরোদমে সচল ছিল। কোনও গণ্ডগোল নজরে আসেনি। কারণ নিয়ে আমরাও ধোঁয়াশায়।’’
ঘটনার পরেই বিজেপির সঙ্গে সিপিএমও অভিযোগ করেছিল, তৃণমূল নেতাদের ‘কাটমানি’ দিতে গিয়েই নিম্ন মানের নির্মাণ হয়েছে। অভিযোগ উড়িয়ে জেলার বাসিন্দা তথা জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের প্রতিমন্ত্রী শ্যামল সাঁতরা দাবি করেন, “আমরা উন্নয়নের কাজে কোনও আপস করি না। বিরোধীরা শুধু ত্রুটি খুঁজতে ব্যস্ত। ওই রিজ়ার্ভারের নির্মাণ নিয়ে যথাযথ তদন্ত হচ্ছে।’’
আর্সেনিক রুখতে সারেঙ্গা-সহ জেলার ১৪টি ব্লকে ২০১২-২০১৬ সালে প্রথম দফায় এগারোশো কোটি টাকা ব্যয়ে নলবাহিত জল প্রকল্পের কাজ হয়। তাই সেই সময়ে তৈরি অন্য রিজ়ার্ভারগুলি নিয়েও বাসিন্দাদের মধ্যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। জেলা জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের সুপারিন্টেডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার সুজয় বাড়ুই বলেন, “জেলার অন্য রিজ়ার্ভারগুলির অবস্থাও খতিয়ে দেখা হবে।’’ ফতেডাঙার ওই রিজ়ার্ভার থেকে যে গ্রামগুলিতে জল সরবরাহ করা হত, সেখানে এ দিন দুপুরের মধ্যে নলবাহিত জল পৌঁছনোর ব্যবস্থা করে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর।