তখন তো টিভি-কম্পিউটার ভিডিও গেমস মোবাইল ছিল না। বিপুল সিলেবাস কিংবা উত্তুঙ্গ কেরিয়ারের আকাঙ্ক্ষা নয়। জ্বর-সর্দি-পোলিও-টিটেনাসের আতঙ্ক, ক্যালরি ঘাটতির ভ্রূকুটি কিচ্ছু নয়। শুধু মাথার মধ্যে কেউ গুঁজে দিয়েছিল পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ আর চোখের সামনে ধরেছিল মস্ত এক ফ্যালাইডোস্কোপ। তাতে সবকিছু ভীষণ রঙিন আর বৈচিত্রময় মনে হতো। ক্ষণে ক্ষণে বদলে যায় নকশার প্যাটার্ন, চোখের সামনে ফুটে উঠত আলপনার নতুন কারুকাজ। বড় বুভুক্ষের মতো গোল গোল চোখ করে সেগুলি গিলতাম আমি।
কত কিছু ছিল তখন। খেলাম দড়ির হাঁড়িকুড়ি ছিল, মাটির পুতুল ছিল, ফুরফুরে তুলোর মতো হাওয়ার মিঠাই ছিল, ছিল বাক্স বায়স্কোপ। এ সবের পিছনে বিশাল চালচ্চিত্রের মতো ছিল এক প্রাণবন্ত সতেজ প্রকৃতি। বড় বড় শস্যখেত, ফুল পাতায় ছেড়ে থাকা গাছপালা, টলটলে জলের পুকুর। একেবারে নিখুঁত একটা পিকচার পোস্টকার্ড। গ্রামের নাম উত্তর ঝাঁপড়দহ মাঝের পাড়া। হাওড়া জেলার বেশ প্রত্যন্ত জায়গা। পাড়াই বা বলি কেন, পরিবার। পরিবারই তো। না হলে, কমলেশ ঠাকুমার বাড়ি মিষ্টি এলে সেই মিষ্টির কিছুটা কেন চলে আসে আমাদের বাড়ি। শেখরকাকু বাজার থেকে লিচু নিয়ে এলে আমরা দু’ভাইবোন ভাগ পাই কেন, কেনই বা বোনের জ্বর তিন-চার উঠে গেলে মায়ের সঙ্গে রাত জাগে পাশের বাড়ির শ্যামলী দিদিমণি। পরিবার বলেই তো মুখ ফসকে ‘শালা’ বলে ফেললে বলাইজ্যাঠা বলে, ‘‘কী বললি? আর কোনওদিন শুনি যদি মেরে পিঠ ফাটিয়ে দেব।’’
আমাদের বাড়ির সামনেই ছোট মাঠ। বিকেল হলেই পাড়ার যত ছেলেমেয়ে সব সেখানে। ফুটবল, ক্রিকেট, বুড়িবসন্ত কিংবা ইচিং-বিচিং। কোনও দিন কুমির ডাঙা। ঘুড়ির সিজনে অবশ্য চলে যাই বড় মাঠে। যার ডাকনাম জলা। পাড়া থেকে বেরিয়ে একটু গেলেই সেই জলা। আলে দাঁড়িয়ে ঘুড়ি ওড়াই। লাটাই ধরে থাকে সুশান্ত। ডাকনাম কিপু। আমি অবশ্য ভাই ডাকতাম। আমার মাঞ্জা দেবার প্রধান অ্যাসিস্ট্যান্ট, জামরুল বা আমড়া চুরির সহষড়যন্ত্রকারী, আমার ফুটবল বা ক্রিকেট প্রতিভার প্রকৃত সমঝদার। প্যাঁচে খেলে যে দিন গো হারান হেরে যেতাম সে দিনও পাড়ার ফিরে বড় বড় চোখ করে হাত-পা নেড়ে বলত—উল্লাসদা আজ ন’টা ঘুড়ি ভো-কাট্টা করে দিয়েছে। খুব ‘দুয়ো-হো-ও-ও-ও’ দিয়েছে।
সামনের মাঠে মাঝে মাঝে ডুগডুগি বাজিয়ে বাঁদর নাচ আসত। গোটা পাড়া ভেঙে পড়ত মাঠে। আমরা ছোটরা গোল হয়ে বসতাম সামনের সারিতে। বাঁদরওলা জোরসে ডুগডুগি বাজিয়ে বলত, ‘ভানুমতীর খেল’। তারপর সে ‘বাচ্চেলোগ তালিয়াঁ’ বললেই কষে তালি দিতাম সবাই। বাঁদরগুলোর কীর্তিকলাপ দেখে তাক লেগে যেত। বাঁদর কোঁচা দুলিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে, লাঠি কাঁধে চৌকিদার হচ্ছে, ভাসুর ঢুকে পড়েছে ঘরে, লজ্জায় ঘোমটা টানছে। আর আসত সাপ খেলা। দারুণ লাগত খেঁদি নাচ। খেঁদি-নাচবি খেঁদি! দু’সতীনে ঝগড়া লাগত তুমুল। কী সব গালাগালি! তুই ওলাউটো, তুই নিংবংশ, তুই ভাতারখাকি, তুই উচ্ছে খাকি, তুই পটলখাকি, তুই করলাখাকি।
হেসে কুটোকুটি সবাই। গণিদিদা বলত, মরণদশা। ওটা ছিল গণিদিদার মুদ্রাদোষ। অশীতিপর বিধবা গণিদিদার বয়েসকাট সাদা চুল, সম্বচ্ছর গায়ে চাকচাক ঘামাচি। সব সবসময় পিটপিট করে দিদা। কে একাদশীতে সিম খাচ্ছে, দ্বাদশীতে পুঁশাক, ত্রয়োদশীতে বেগুন, কিংবা কোনও বাড়ির কর্তা বেরবার সময় সামনে শূন্য কলসি রাখা, কেউ বা যাত্রা মুহূর্তে কাঁচকলা কিংবা সূচের নাম করে ফেলল—সব নজরে পড়ে যেত দিদার। দিদার রাইট ছিল পাড়ার সব বউ-ঝিদের ধমক দেবার।
সাড়ে সাত থেকে ন’টাকা বাজেটের মধ্যে যে কোনও পুজো সেরে ফেলতাম আমরা। এমনকি দুর্গা পুজো পর্যন্ত। পাড়ার সবাই দশ বিশ পয়সা করে চাঁদা দিত। মায়ের পুরনো কাপড় টাঙিয়ে প্যান্ডেল বানাতাম। ভেতরে রঙিন কাগজের কারুকাজ। ন্যাপালের দাদা গোপাল ছিল আমাদের পার্মানেন্ট পোটো। তার হাতের সরস্বতী দেখে অনেকেই বিশ্বকর্মা বলে ভুল করত। কার্তিকের ময়ূর আর লক্ষ্মীর পেঁচার মধ্যেও নাকি প্রভেদ থাকত না বিশেষ। মা কালীর জিভ ঠোটের চেয়ে বেশি চওড়া হয়ে যেত কখনও কখনও। তাতে কী। নিষ্ঠা আর ভক্তিটাই আসল কথা! তাতে তো এতটুকু ঘাটতি ছিল না আমাদের। হাফপ্যান্ট পরে গলায় পাটের দড়ির পৈতে ঝুলিয়ে পুজোয় বসতাম আমি নিজে। মানিক বা সত্য ওদের ঠাকুরের ধূপকাঠি বের করে আনত চুপিচুপি। তোবড়ানো অ্যালমুনিয়ামের বাটিতে কাটা ফল। কারও গাছের কাঁচা পেঁপে পেয়ারা কারও গাছের বাতাবি লেবু। ঠাকুরের কৃপা বেশি পেলে জোগাড় হয়ে যেত একখণ্ড আখ। বাতাসাটা অবশ্য দোকানদাদুর দোকান থেকে নগদে কেনা। পুজো করে কখনও সখনও দু’চার আনা উদ্বৃত্ত থাকত। সেই পয়সায় হাতিঘোড়া বিস্কুট বা টিকটিকি লজেন্স। সবার চেয়ে আমার ভাগ একটু বেশি। পুরোহিতের দক্ষিণা আর কী!
পোষ্য ছিল নানা রকম। কুকুর বেড়াল থেকে শুরু করে টিয়া পাখি শালিক পাখি। অ্যাকোয়ারিয়াম কিনে দেবার সামর্থ্য ছিল না বাবার, তাই লাল নীল মাছ পুষতাম অ্যালুমিনিয়াম হাঁড়িতে। বাজার থেকে কেনা জ্যান্ত দুটো পুঁটি মাছেরও স্থান হয়েছিল সেখানে। গাঁ গাঁ শব্দে উড়ো জাহাজ গেলে যে যেখানেই থাকি দৌঁড়ে এসে ঊর্ধ্বমুখে তাকাতাম। একটা মোটর বাইক এলে ঘিরে দাঁড়াতাম সকলে। কিপু আমাকে প্রায়ই বলত, বুঝলি বড় হলে একটা বাইক কিনবই। বুলেট।
ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় ওই পাড়া ছেড়ে চলে এলাম একটু দূরে বেগড়ির কেশবপুর গ্রামে। তার পর অদ্যাবধি টানা ৩৩ বছর এখানে। প্রথম প্রথম ভারি মন কেমন করত ফেলে আসা সেই জায়গাটার জন্যে। ধীরে ধীরে এখানে নতুন পড়শি হল, নতুন বন্ধু। সে সব অন্য গল্প।
কিন্তু আজও, এই বয়েসে এসেও টের পাই বুকের গভীরে কোথাও অমলিন বয়ে গেছে সেই পিকচার পোস্টকার্ড। মাঝে মাঝে পুরনো সহপাঠীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। খবর পাই ঠাকুমা, বলাইজ্যেঠু, শ্যামলী দিদিমণি দোকানবন্ধু আর নেই। তাজা তরুণ বয়েসে সুশান্তও ছেড়ে চলে গেছে সবাইকে। ভাবি যাব কিন্তু হয়ে ওঠে না। তবু কখনও কখনও আনমনে রাস্তায় চলতে চলতে বাচ্চা ছেলেদের মুখে ‘ভো-কাট্টা’ শুনে চমকে যাই আজও। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি কাটা ঘুড়ি ভেসে ভেসে যাচ্ছে। আমিও চলি ঘুড়ির সঙ্গে। এক সময় পৌঁছে যাই সেই মাঠে। যেখানে বাঁদরওলা সজোরে ডুগডুগি বাজিয়ে বলছে—বাচ্চালোগ তালিয়াঁ!