স্বাধীনতা দিবসের আগে সিআরপি-র বিশেষ তল্লাশি ঝাড়গ্রামের কলাবনি জঙ্গলে। দেবরাজ ঘোষের তোলা ছবি।
গুরু যে কথাটা তাঁর দেশে ৬৬ বছর আগে বলেছিলেন, সে কথা এখন বলছেন শিষ্যরাও।
১৯৪৯ সালে মাও জে দং ঘোষণা করেন— চিনে গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার যে লড়াই ১৯২৭ থেকে তাঁরা চালাচ্ছিলেন, আন্দোলনের সেই পর্যায়ের ইতি ঘটল। পার্টির ভরকেন্দ্র এ বার গ্রাম থেকে সরিয়ে আনা হবে শহরে।
চিনের সেই বিপ্লবী নেতাকে গুরু স্বীকার করা ভারতের মাওবাদী দলটির নেতৃত্বেরও এখন একই উপলব্ধি। তবে পার্থক্যটা হল— মাও জে দং গ্রামে পোক্ত সংগঠন গড়ার সাফল্যকে শহরে ছড়িয়ে দিতেই এই কৌশল পরিবর্তন করেছিলেন। আর এ দেশের মাওবাদীরা বুঝেছেন— পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে এখনও দাঁত ফোটানো কঠিন। সেই কারণেই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে শহর ও শহরতলিতে পার্টিকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে।
সম্প্রতি মাওবাদীরা জঙ্গলমহলে যৌথ বাহিনীর উপর বড় সড় হামলার ছক কষেছে বলে রাজ্যকে সতর্ক করেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। পাশাপাশি কলকাতা ও আশপাশের কয়েকটি মফস্সল শহরে মাওবাদীরা পুরনো ঘাঁটিগুলোয় নতুন ভাবে সংগঠন তৈরি করার কাজে নেমেছে বলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রিপোর্ট এসেছে রাজ্যের কাছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, সরকারের কাজে বিক্ষুব্ধ মানুষদের থেকে নতুন ক্যাডার নিয়োগের কৌশল নিয়েছে মাওবাদীরা। পাশাপাশি বসে যাওয়া সদস্য-সমর্থকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফের কাজকর্ম শুরুর আর্জি জানাচ্ছেন মাওবাদী নেতৃত্ব।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের এই রিপোর্ট হাতে আসার কিছু দিন আগেই খাস বর্ধমান ও চুঁচুড়ায় সিপিআই (মাওবাদী) রাজ্য কমিটির নামে ছাপানো লিফলেট উদ্ধার করেছেন গোয়েন্দারা। সেই সঙ্গে কলকাতার বেলেঘাটা ও মানিকতলার মতো পুরনো ঘাঁটি, উত্তর শহরতলির বাগুইআটি, উত্তর ২৪ পরগনার খড়দহ, টিটাগড় ও ব্যারাকপুর, নদিয়ার শান্তিপুর এবং হাওড়ার বালি ও জগদীশপুরে মাওবাদীরা সংগঠন তৈরির কাজে হাত দিয়েছে বলে গোয়েন্দাদের দাবি। তাঁদের বক্তব্য, রাজ্যের যে সব জায়গায় কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে, সেখানে গিয়ে মাওবাদীরা ক্যাডার নিয়োগ করার চেষ্টা শুরু করেছে।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা আইবি-র একটি সূত্রের খবর অনুযায়ী, অনলজি নামে এক মাওবাদী নেতাকে আপাতত পশ্চিমবঙ্গের কাজকর্ম দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছে মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় কমিটি। অনলজি ঝাড়খণ্ডের নেতা, আসল নাম পরিমল মাঝি। তাঁর তত্ত্বাবধানেই কলকাতা ও শহরতলিতে মাওবাদীরা নতুন করে সংগঠন তৈরি করার কাজে হাত দিয়েছে। গোয়েন্দাদের দাবি, বহু তর্কবিতর্কের পর আকাশ ওরফে অসীম মণ্ডলকেই শেষ পর্যন্ত পার্টির রাজ্য সম্পাদক মনোনীত করেছে মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।
রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দাদের মতে, তৃণমূল আমলে জঙ্গলমহলে যে ভাবে ঢালাও অনুদান বিলি ও সরকারি প্রকল্প রূপায়ণ করা হচ্ছে, তাতে এখনই সরকারের বিরুদ্ধে বড় ধরনের ক্ষোভ তৈরি হওয়া দুষ্কর। মাওবাদীরা বুঝেছে, জঙ্গলমহলেএখন আর লালগড়ের মতো জঙ্গি আন্দোলন গড়ে তোলা মুশকিল। এক গোয়েন্দা-কর্তার পর্যবেক্ষণ, ‘‘যে সব যুবক জুনিয়র কনস্টেবলের চাকরি পেয়েছেন, তাঁরা নিজেদের তল্লাটে চোখ কান খোলা রাখছেন। যাঁরা চাকরি পাননি, তাঁদের একাংশ ভবিষ্যতে শিকে ছেঁড়ার আশায়। ওদের খেপানো বেশ শক্ত।’’ গোয়েন্দারা বলছেন, ‘‘তল্লাশিরত নিরাপত্তা বাহিনীর উপরে যে কোনও দিন চোরাগোপ্তা হামলা, ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ হতেই পারে। কিন্তু শিলদা বা সাঁকরাইলের মতো বড়সড় হামলা চালিয়ে পালাতে গেলে বিস্তীর্ণ এলাকায় জনসমর্থন থাকা দরকার, যেটা মাওবাদীদের এখন নেই।’’
সিপিএমের এক রাজ্য নেতাও স্বীকার করে নিচ্ছেন, ‘‘দু’টাকা কেজি চাল জঙ্গলমহলের গরিব মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করেছে।’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘কিছু গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতিতে দুর্নীতির কারণে স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের উপর ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু যতটা সুবিধে মানুষ পাচ্ছেন, সেই তুলনায় ক্ষোভের পরিমাণ এখনও কম।’’ গোয়েন্দারা জেনেছেন, শহর ও শহরতলির পরিস্থিতিকে সংগঠন তৈরির জন্য মাওবাদীরা এখন অনেকটাই অনুকূল বলে মনে করছে। আইবি-র হাতে মাওবাদীদের যে নথি এসেছে, সে সব দেখে গোয়েন্দারা বলছেন, সরকারি কর্মচারীদের বকেয়া ডিএ, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে নানা সমস্যার কারণে মফস্সল ও শহরের মানুষের একটা বড় অংশ বর্তমান সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ। অথচ বিরোধী দলগুলির কোনওটাই অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
আর এই শূন্যস্থানই মাওবাদীরা পূরণ করতে চাইছে। এ ক্ষেত্রে তারা সামনে রাখতে চাইছে শহরে পার্টির পুরনো সমর্থক ও সহানুভূতিশীলদের, যাঁদের একাংশ লালগড় আন্দোলনের সময়ে জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের নির্বিচার হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে না পেরে বসে গিয়েছিলেন। মাওবাদীরা বিবৃতি দিয়ে লালগড়ের নির্বিচার হত্যা ও লাশ গায়েব করার ভুলও স্বীকার করেছে। গোয়েন্দাদের মতে, এই ভাবেই মাওবাদীরা ওই সব বসে যাওয়া শহুরে সমর্থকদেরই ফের কাছে টানতে চাইছে।
আজ অনশনে মাওবাদী বন্দিরা
আজ, শনিবার ৬৯ তম স্বাধীনতা দিবস। মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারেই দিনটিকে প্রতিবাদ দিবস হিসেবে পালন করবেন জানিয়ে দিলেন মাওবাদী সন্দেহে ধৃত বন্দিরা। জেল সুপার স্বরূপ মণ্ডলকে চিঠি দিয়ে তাঁরা জানিয়েছেন আজ মেদিনীপুর জেলে অনশন করবেন মোট ৩৯ জন বন্দি। তাঁদের মধ্যে ৩৬ জন পুরুষ ও ৩ জন মহিলা। তাঁদের দাবি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিশ্রুতি মতো মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে, রাজনৈতিক বন্দিদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে, মৌলিক অধিকারে রাজ্যের হস্তক্ষেপ করা চলবে না, জেলে নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।