ছবি আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
রাজনীতিতে আমাকে তুই বলার আর কেউ রইল না। সুব্রত আর আমি কত বছরের বন্ধু, সেই হিসেব কষতে বসলে সব অঙ্ক নিজেরই গোলমাল হয়ে যাবে। শুধু এটুকু বলছি, সুব্রত যখন নেতা নয়, মন্ত্রী নয়, আমিও রাজনীতিতে নবীন। তখন থেকে সুব্রতর সঙ্গে আমার সম্পর্ক। এর পর প্রিয়দা, আমি, সুব্রত একসঙ্গে ছাত্র আন্দোলন করেছি। পরে সুব্রত বিধায়ক হয়েছে। মন্ত্রী হয়েছে। নেতৃত্বে অনেক দূর এগিয়েছে। দীর্ঘ সময় মন্ত্রিত্ব করেছে। তখনও নানা ভাবে ওঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ কিন্তু থেকেই গিয়েছে।
রাজনীতির কথা পরে বলব। তার আগে বলি, ও কত মজার মানুষ, সেই কথা। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের সরকারে সুব্রত মন্ত্রী হল। এক দিন সকালে ফোন করে বলল, ‘‘আয়, জরুরি কথা আছে।’’ ওর বাড়ি পৌঁছলাম। বলল, ‘‘চল, পুরী ঘুরে আসি।’’ আমি বললাম, ‘‘পুরী যাবি কী রে? জামাকাপড় তো কিছুই আনিনি।’’ ও বলল, ‘‘আরে, জামাকাপড় আনলে আর যাওয়ার মজা কী। এমনিই চল।’’ চলে গেলাম। হইহই করে দু’দিন কাটিয়ে ফেরা।
এ সবের অনেক আগে আর এক বার জলপাইগুড়িতে ও আর আমি দলের মিটিং করতে গেছি। সুব্রত বলল, ‘‘শোন, দার্জিলিংয়ে মোহনবাগানের খেলা আছে। এখানে তুই তিন মিনিট বলবি। আমি দশ মিনিট। তারপর সোজা দার্জিলিংয়ে গিয়ে খেলা দেখব। সময়টা খেয়াল রাখিস।’’ হু হু ঠান্ডায় ধুতি-পাঞ্জাবি পরে আমরা দার্জিলিংয়ে পৌঁছলাম। সেখানে সোয়েটার কিনে গায়ে দিয়ে খেলা দেখে তবে শান্তি। মোহনবাগান না জিতলে খুব মুষড়ে পড়ত সুব্রত। আর জিতলে ওকে পায় কে!
প্রিয়দার সঙ্গে সুব্রতর সম্পর্কটা যে কত গভীর ছিল তা আমার বলার অপেক্ষা রাখে না। আসলে সেই সময় আমাদের সকলের নেতা ছিলেন শ্যামল ভট্টাচার্য। সেখান থেকে প্রিয়দা নেতৃত্বের দক্ষতা দিয়ে নিজের টিম গড়ে নেন। সুব্রত সেই টিমের সেনাপতি। কত ঘটনা, কত আন্দোলন, কত ঝগড়া, মতভেদ যে হয়েছে, আজ আমার এই ভেঙে পড়া মানসিক অবস্থায় সে সব গুছিয়ে বলতেও পারব না। শুধু এটা বলছি, যত ঝগড়া তত ভাব। যত দূরত্ব তত নৈকট্য— এই হল আমাদের সুব্রত। সুব্রতর রাজনৈতিক জীবনে বহু পরত আছে।
আমি একটা অন্য কথা বলি। তাতে ও যে কত মজার মানুষ, তার প্রমাণ মিলতে পারে। আমরা তখন প্রিয়দার টিম করি। কী একটা কারণে কুমুদ ভট্টাচার্যের সঙ্গে মনোমালিন্য হল। সুব্রত ওর বাড়ির সামনে কুমুদের নামে শহিদ বেদি করে তাতে মালা দিল। সেই খবর কুমুদের কাছে পৌঁছতেই আর এক কেলেঙ্কারি। শেষ পর্যন্ত প্রিয়দা আমাকে পাঠাল মিটমাট করতে।
সুব্রতর সঙ্গে আমার রাজনৈতিক বিভেদ হয়েছে অনেক বার। ও যখন আইএনটিইউসিকে সিটুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে যৌথ আন্দোলনে নিয়ে যায়, আমার মতো কয়েক জন তাতে সায় দেয়নি। সেই দূরত্ব বেশ কিছু দিন ছিল। আমি যখন আইএনটিইউসির সাধারণ সম্পাদক এবং সুব্রত সভাপতি, তখন আমাকে বলল, ‘‘তুই নতুন কমিটির একটা লিস্ট বানা।’’ আমি লিস্ট বানাতে বসলাম। সেই সময় সুব্রত বক্সী আমাকে চুপিচুপি বলল, আসল লিস্ট থেকে কিন্তু তোমার নামটা বাদ যাবে। আমার অবস্থাটা বুঝুন।
সুব্রতর জীবনে আমার স্ত্রী প্রয়াত সুপ্রিয়ার তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা আছে। সে সব আমাদের প্রেম বা বিয়ের বহু আগের কথা। সুব্রত ১৯৭১ এবং ’৭২ সালের দু’টি নির্বাচন লড়েছিল সুপ্রিয়াদের বন্ডেল রোডের বাড়ির ঠিকানায়।
আমার স্নেহাস্পদ এবং তথা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ও অন্যতম নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে সুব্রতর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে। মমতার ছাত্র রাজনীতিতে উত্থান সুব্রতের ঘর থেকে। আবার মমতা যখন তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করে, তখন সুব্রত মমতার নেতৃত্বে তৃণমূলে যোগ দেয়। তারপর এক সময় তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোটেও লড়ে। কিন্তু এটা দেখেছি সেই দূরত্বটাও সুব্রত মন থেকে মেনে নিতে পারত না। তাই আবার সে তৃণমূলে ফিরে আসে। মমতা ওকে যথোপযুক্ত মর্যাদাও দেয়।
সুব্রত যখন কলকাতার মেয়র, তখন আমি পুরসভার ইউনিয়ন নেতা। বার বার দাবিদাওয়া নিয়ে ওর কাছে গিয়েছি। ঝগড়া হয়েছে। পরস্পরের বিরুদ্ধে দু’জনেই প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়েছি। কিন্তু সে সব তো রাজনীতির কথা।
যে সুব্রত প্রায় ৫০ বছরেরও বেশি সময় আমার বন্ধু, তাকে অন্য কোনও মাপকাঠিতেই আমি বিচার করতে চাই না। আমি ওর থেকে সামান্য বড়। বন্ধুবিচ্ছেদ করে ও আগে চলে গেল।