সোমবার সকাল থেকে সব স্বাভাবিক উরমা স্টেশনে। ছবি: সুজিত মাহাতো।
বোমা ফেটেছিল নাকি অন্য কিছু? রবিবার রাতে পুরুলিয়ার উরমা স্টেশন থেকে কিছুটা দূরে দক্ষিণ প্রান্তের কেবিনের কর্মীদের কানে আসা বিস্ফোরণের মতো একটি শব্দ ঘিরে রহস্য বাড়ছে।
ঘড়ির কাঁটা তখন সবে রাত এগারোটা পেরিয়েছে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। নিঝুম রাতে চারপাশ পুরো সুনসান। হঠাৎই তাঁদের কানে এল বিস্ফোরণের মতো শব্দ! অত রাতে বোমা ফাটার আওয়াজ পেয়ে আর আর বাইরে বেরোতে সাহস করেননি দক্ষিণ-পূর্ব রেলের আদ্রা ডিভিশনের উরমা স্টেশনের ওই দক্ষিণ কেবিনের গেটম্যানেরা। অতীতে একাধিক মাওবাদী নাশকতার সাক্ষী থেকেছে এই স্টেশন। পুরুলিয়ার মাওবাদী প্রভাবিত বলরামপুরের ঘাটবেড়া-কেরোয়া অঞ্চল লাগোয়া এই স্টেশন। বাম আমলে ঘাটবেড়া-কেরোয়া মাওবাদীদের ‘মুক্তাঞ্চল’ হিসাবে পরিচিত ছিল। ওই এলাকা-সহ বলরামপুরে সেই সময় প্রচুর বামপন্থী কর্মী খুন হয়েছেন মাওবাদীদের হাতে। পাশাপাশি রেল লাইনে বিস্ফোরণ, স্টেশন ম্যানেজারকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া, মাওবাদীদের হুমকির জেরে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে থাকা—অতীতে এমন নানা ঘটনা ঘটেছে উরমা স্টেশনকে ঘিরে।
রেল সূত্রে জানা গিয়েছে, রবিবার রাতে ওই কেবিনে ডিউটিতে ছিলেন নিরঞ্জন মাহাতো ও রাধানাথ মাহাতো। নিরঞ্জনবাবুর কথায়, ‘‘হঠাৎই বিস্ফোরণের মতো শব্দ পেলাম। আমরা ভয় পেয়ে কেবিনের দরজা-জানলা বন্ধ করে দিই। আর বেরোনোর সাহস করিনি।’’ তাঁদের কাছে খবর পেয়ে উরমার স্টেশন ম্যানেজার রতন কেরকেট্টা ওই কেবিনে পৌঁছন। পুরুলিয়ায় রেলপুলিশকে সব জানান। খবর যায় বলরামপুর ও আড়শা থানাতেও। কিন্তু, ঝুঁকি নিতে চাননি রেল কর্তৃপক্ষ। পুলিশ, আরপিএফ পৌঁছনোর আগেই ওই রেল লাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়। সে সময় ওই লাইন দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল নয়াদিল্লি-পুরী পুরুষোত্তম এক্সপ্রেস ও ভুবনেশ্বর-নয়াদিল্লি সম্পর্কক্রান্তি এক্সপ্রেসের। পুরুষোত্তমকে কাঁটাডি স্টেশনে ও সম্পর্কক্রান্তিকে বরাভূম স্টেশনে আটকে দেওয়া হয়।
খবর পেয়ে রাতেই ঘটনাস্থলে যান পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার রূপেশ কুমার। এলাকায় তল্লাশি চালানো হয়। কিন্তু লাইনে কোনও বিস্ফোরক রয়েছে কিনা, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। তাই বরাভূম স্টেশন থেকে একটি লাইট ইঞ্জিন পুরুলিয়ার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। পুরুলিয়া থেকেও একটি মালগাড়ির হেডলাইট জ্বেলে গতি কমিয়ে বরাভূমের নিয়ে আসা হয়। এই গাড়ি থেকেই লাইন পরীক্ষা করতে করতে যান রেলপুলিশ ও রেলরক্ষী বাহিনীর জওয়ানেরা। সন্দেহজনক কিছু না মেলায় দু’টি এক্সপ্রেস ট্রেনকে রওনা দেওয়ার সবুজ সঙ্কেত দেওয়া হয়।
পুলিশ সুপার সোমবার বলেন, ‘‘একটা শব্দ পেয়েছিলেন রেলের কর্মীরা। কিন্তু, এলাকা তল্লাশি করে কিছুই পাওয়া যায়নি।’’ রাজ্য পুলিশের আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) সিদ্ধিনাথ গুপ্ত বলেন, ‘‘বিস্ফোরণ হলে তার কিছু চিহ্ন থাকত। পুলিশের তল্লাশিকে সে রকম কিছুই মেলেনি। তবে আমরা সতর্ক রয়েছি। নজর রাখছি।’’ আদ্রার ডিআরএম অনশুল গুপ্ত বলেন, ‘‘একটা শব্দ পেয়েছিলেন রেলকর্মীরা। তার ভিত্তিতে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ তদন্ত করছে। দু’টি ট্রেনকে রাতে আটকানো হয়েছিল। তবে এদিন ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।’’
তল্লাশিতে বিস্ফোরণের চিহ্ন না পেলেও রবিবার রাতের ঘটনায় দুশ্চিন্তা বেড়েছে পুলিশ-প্রশাসনের। বিশেষ করে এলাকাটি বলরামপুর হওয়ায় উদ্বেগ আরও বেশি। গোয়েন্দাদের রিপোর্ট অনুযায়ী জঙ্গলমহলে ফের মাওবাদীদের আনাগোনা শুরু হয়েছে। মে মাসের শেষ সপ্তাহে আদিবাসী মূলবাসী জনসাধারণের কমিটির পোস্টারও মিলেছে এই ঘাটবেড়া-কেরোয়া এলাকায়। মে মাসের শেষ সপ্তাহে জঙ্গলমহলের পরিস্থিতি নিয়ে জঙ্গলমহলের জেলাগুলির পুলিশ সুপারদের নিয়ে বৈঠকও করেছেন রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডি। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে সোমবার গোয়েন্দা বিভাগের লোকজনও উরমা স্টেশনে গিয়ে গোটা এলাকা ঘুরে দেখেন। তবে তাঁরা কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
ওই ঘটনার পরে শুরু হয়েছে নাগা বাহিনীর টহলদারিও। অযোধ্যা পাহাড়তলির শিরকাবাদে সোমবার ছবিটি তুলেছেন প্রদীপ মাহাতো।
সম্প্রতি বৈঠকে বসেছিল রাজ্যে সক্রিয় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয় কমিটি। সেই বৈঠকে পেশ হওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে যে রিপোর্টটি তৈরি হয়েছে, তার মূল কথাই হল— ‘পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে ফের সক্রিয় হচ্ছে মাওবাদীরা। ইতিমধ্যেই পশ্চিম মেদিনীপুর এবং পুরুলিয়ার কয়েকটি স্থানে তারা প্রায় নিয়মিত আনাগোনা শুরু করেছে।’ রাজ্য পুলিশকে সতর্ক করে গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, বর্তমান সরকারের কাজকর্মে জঙ্গলমহলের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তাঁদেরই একাংশ এখন মাওবাদীদের দিকে ঝুঁকছে। গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, বর্ষায় জঙ্গল ঘন হয়ে উঠলেই মাওবাদীদের তৎপরতা বাড়তে পারে। যার জেরে ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে জঙ্গলমহলের তিন জেলা বাঁকুড়া-পুরুলিয়া-পশ্চিম মেদিনীপুর। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, ঘাটবেড়া-কেরোয়া পঞ্চায়েতের যুগিডি, কাশিডি, বুড়িডি-র মতো গ্রামগুলিতেই এখন আবার যাতায়াত শুরু করেছে মাওবাদীরা। মনে করা হচ্ছে, ওই অধরা নেতারাই এলাকায় ফের সংগঠন গড়ার চেষ্টা শুরু করেছেন।
কিন্তু, সব ছাপিয়ে প্রশ্ন হল, রবিবার রাতে কীসের আওয়াজ শুনেছিলেন কেবিনের কর্মীরা? রহস্যটা কিন্তু রয়েই গেল!