দলের মধ্যে চাপা ক্ষোভ এবং গুঞ্জন ছিলই। বিধানসভা ভোটের আগে সেই ক্ষতই ফের সামনে এনে ফেললেন সৌগত রায়! এবং তার জন্য যথারীতি ফের তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের উষ্মার কারণ হলেন এই প্রবীণ সাংসদ!
পুরভোটে বিস্তর গা-জোয়ারির অভিযোগ উঠেছিল শাসক দলের বিরুদ্ধে। বিধাননগরের পুরভোটে যা বিরাট আকার নিয়েছিল। সেই দৃষ্টান্ত মাথায় রেখেই আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে সুষ্ঠু ভাবে ভোট করার জন্য রবিবার দলের কর্মীদের পরামর্শ দিয়েছেন সৌগতবাবু। ‘সব জিততে হবে’— এই মানসিকতা ছাড়ার জন্য শাসক দলকে বার্তাও দিয়েছেন তিনি। প্রায় তাঁর সুরই শোনা গিয়েছে মন্ত্রী ব্রাত্য বসুর গলায়। যা অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে!
ব্রাত্যর কেন্দ্রে নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য দমদমের হেল্থ মাঠে তৃণমূলের কর্মিসভা ছিল এ দিন। সেখানে সৌগতবাবু বলেন, ‘‘দেখবেন, বিধানসভা ভোটে যেন জল মেশানোর অভিযোগ না ওঠে! এর আগে কোনও কাউন্সিলরের ভোটে যদি জল মিশে থাকে, তা হলে এ বার সেই প্রলোভন ছাড়তে হবে। সবাই জিততে চায়! সে জন্যই প্রলোভন তৈরি হয় এবং ভোটে জল মেশানোর অভিযোগ ওঠে। মানুষ ক্ষুব্ধ হন।’’ সৌগতবাবুর পরামর্শ, ‘‘ক্ষুব্ধ মানুষের কাছে যান। বলুন, ভুল হয়েছে! যা হয়েছে, ভুলে যান। দলের স্বার্থে তাঁর কাছে যান।’’ ব্রাত্যও এ দিন ওই সভায় বলেন, ‘‘অবাধ ও স্বচ্ছ ভোট করুন। তাতে ব্যবধান কমলে কমবে! কিছু এসে যায় না।’’
বস্তুত, ‘সব চাই’ মানসিকতাই গত পুরভোটে কলকাতা ও অন্যত্র গা-জোয়ারির পথে নিয়ে গিয়েছিল শাসক দলকে। সেই জবরদস্তিই আরও চরমে পৌঁছয় বিধাননগর পুরভোটে। বহু সাধারণ নাগরিক সে বার ভোট দিতে পারেননি বলে অভিযোগ করেছিলেন। আক্রান্ত হয়েছিলেন অন্তত ২২ জন সাংবাদিক! নাগরিক সমাজে প্রবল প্রতিক্রিয়া হয়েছে দেখে দলের অন্দরে স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন বলে তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর। কেউ কেউ আবার এমনও বলেছিলেন, মুকুল রায় দায়িত্বে থাকলে এমন ‘বাড়াবাড়ি’ হতো না! তখনও পর্যন্ত দলে ‘ব্রাত্য’ মুকুল নিজেও আকারে-ইঙ্গিতে সেই বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধেই সরব হয়েছিলেন। তাতে আরও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী। সৌগতবাবুর এ দিনের বক্তব্যে স্বীকারোক্তি স্পষ্ট যে, তখন সত্যিই বাড়াবাড়ি হয়েছিল। যে কারণে এ বার দলীয় নেতৃত্বের উষ্মা আরও বেশি!
বিধাননগরের ভোটের জল তার পরে অবশ্য গড়িয়েছে বহু দূর। বিধানসভা ভোটের প্রস্তুতির জন্য প্রথম বার রাজ্য সফরে এসে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের ফুল বেঞ্চ বিরোধীদের তুলে দেওয়া সে দিনের ঘটনার ফুটেজ দেখেছে। খোদ মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নসীম জৈদী বলে গিয়েছেন, বিধানসভায় কেউ ভোট দিতে না পারলে দায়ী থাকবেন জেলাশাসক। তার পর থেকেই রাজ্য প্রশাসনের ওপর চাপ বেড়েছে। এমতাবস্থায় ‘ভুল স্বীকারে’র জন্য কর্মীদের প্রতি সৌগতবাবুর পরামর্শ শাসক দলের বিড়ম্বনা যে বহু গুণ বাড়িয়ে দেবে, তা স্বাভাবিক!
দলকে অস্বস্তিতে ফেলে এর আগে বেশ কয়েক বার ‘বেফাঁস’ কথা বলে ফেলেছেন সৌগতবাবু! তাঁর পথে ‘ভুল স্বীকার’ তৃণমূলের রেওয়াজ নয়! দমদমের সাংসদের এ দিনের মন্তব্যও দলের মধ্যে ফের পরিস্থিতি জটিল করেছে। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘ওঁরা এমন কথা বলেছেন কি না, খোঁজ নেব। যদি বলে থাকেন, এটা আমাদের দলের রাজনৈতিক বক্তব্য নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে গত পঞ্চায়েত, লোকসভা এবং পুরসভার ভোট সুষ্ঠু ভাবেই হয়েছে। মানুষ গণতন্ত্র ফিরে পেয়েছেন।’’ পার্থবাবুর আরও সংযোজন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের উন্নয়ন করে দেখিয়েছেন। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের আরও কাজ করতে হবে। যে মানুষ সঙ্গে নেই, তাঁদের কাছে আনতে হবে। এটাই আমাদের দলের বার্তা।’’
সম্মেলনের পরে সৌগতবাবুকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তা হলে কি তিনি মেনে নিচ্ছেন, পুরভোটে জল মিশেছিল? তখন অবশ্য তাঁর জবাব ছিল, ‘‘কাউন্সিলরেরা এ রকম কিছু করেছেন কি না, সে ব্যাপারে আমার কাছে কোনও খবর নেই! কিন্তু কথাগুলো বললাম, যাতে সিপিএম পরে এ জাতীয় অভিযোগ তোলার সুযোগ না পায়!’’
সৌগতবাবু এ দিন অবশ্য তৃণমূল নেত্রীর পথের প্রশংসাও করেছেন। তিনি এ দিন বলেন, ‘‘বামেদের নবান্ন অভিযানের দিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুলিশকে বলেছিলেন, গুলি চালানো যাবে না। এটাই পথ।’’ আগামী চার মাস কর্মীদের অনেক বেশি ‘রাজনৈতিক’ হওয়ার আহ্বান জানান সৌগতবাবু। নৈহাটির বিধায়ক পার্থ ভৌমিকও এ দিন কর্মীদের বলেন, ‘‘অতি তৃণমূলী হবেন না!’’