জনস্বার্থে শিল্পায়ন হতেই পারে বলে সিঙ্গুর মামলায় মন্তব্য করল সুপ্রিম কোর্ট। আজ শীর্ষ আদালত জানিয়েছে, শিল্পায়নে বাধা হয় এমন কোনও রায় দেওয়া হবে না।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জমানায় সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ আইনমাফিক হয়েছিল কি না, তা এখন খতিয়ে দেখছে শীর্ষ আদালত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ক্ষমতায় আসার পরে রাজ্যের পক্ষে আদালতকে জানানো হয়েছিল, বাম আমলে সিঙ্গুরে সঠিক পদ্ধতি মেনে জমি নেওয়া হয়নি। বাড়তি সুবিধে দেওয়া হয়েছিল টাটাদের। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অভিযোগ ছিল, সিঙ্গুরের জমি না পেলে রাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি দিয়েছিল টাটারা। এই অভিযোগ নিয়ে মুখ খুলে টাটা মোটরসের আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি আজ বলেন, তাদের কোনও বাড়তি সুবিধে দেওয়া হয়নি। একাধিক জমি দেখার পরে সিঙ্গুরের সুবিধাজনক অবস্থানের কারণে জমিটি বেছে নিয়েছিল টাটারা। জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়াতেও তারা ছিল না। সিঙ্ঘভি জানান, টাটারা কোথাও বলেনি যে ওই জমি না পেলে তারা রাজ্য ছেড়ে চলে যাবে। টাটারা কেবল রাজ্য সরকারকে তাদের মতামত জানিয়েছিল।
এর পরেই শুনানিতে উঠে আসে জনস্বার্থে উন্নয়ন ও অধিগ্রহণের বিষয়টি। প্রশ্ন ওঠে, জনস্বার্থের কথা বলে কি এ ভাবে এত জমি অধিগ্রহণ করা যায়? উত্তরে সিঙ্ঘভি একাধিক উদাহরণ তুলে দাবি করেন, জনস্বার্থে বিভিন্ন রাজ্যে একাধিক জায়গায় জমি অধিগ্রহণ হয়েছে। বিচারপতি অরুণকুমার মিশ্র মন্তব্য করেন, কোথাও অটোমোবাইল শিল্প হলে স্থানীয় এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হয়ে থাকে। জনস্বার্থে শিল্পায়ন হতেই পারে। আদালত এমন কিছু রায় দেবে না যাতে উন্নয়ন বাধা পায়।
গত শুনানিতে বিচারপতিদের প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন টাটারা। আজ পালা ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের। আদালত এ দিন রাজ্য সরকারের কাছে জানতে চায়, ১০৫৩ একরের মধ্যে কত জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। কত লোক ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন। অধিগ্রহণের নোটিসের এক মাসের মধ্যে অনিচ্ছুক কৃষকদের কতগুলি আবেদন জেলাশাসকের কাছে জমা পড়েছিল। জেলাশাসকের সেই রিপোর্ট জমা পড়ার পরেই রাজ্য প্রশাসন অধিগ্রহণ শুরু করেছিল কি না, তা-ও জানতে চায় আদালত। প্রশ্ন ওঠে রাজ্য সরকারের একাধিক বার অবস্থান পরিবর্তন নিয়েও।
সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণের প্রশ্নে একাধিক বার ডিগবাজি খেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। অধিগ্রহণের বিষয় নিয়ে তিন-তিনখানা হলফনামা দিয়েছে রাজ্য সরকার। যেগুলি পরস্পরবিরোধী। কেন বারবার এই অবস্থান পরিবর্তন তা নিয়ে আজ রাজ্য সরকারের আইনজীবীর কাছে প্রশ্ন তোলে শীর্ষ আদালত। রাজ্যের আইনজীবী রাকেশ দ্বিবেদী শীর্ষ আদালতে জানান, এমন কোনও আইন নেই যে আগের সরকারের অবস্থান বদল করতে পারে না পরবর্তী সরকার।
ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দল পাল্টে গেলে সরকারের অবস্থানও বদলে যেতে পারে।
শুরু থেকেই মমতা সরকারের আইনজীবীদের বক্তব্য ছিল, সিঙ্গুরে যে ভাবে টাটাদের জমি দেওয়া হয়েছিল, তা দেখে মনে হয় একটি বিশেষ সংস্থাকে বাড়তি সুবিধে পাইয়ে দিতে তৎপর ছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার। টাটাদের জমির জন্য টাকা দিতে না হলেও, অনুসারী শিল্পের ভেন্ডারদের টাকা দিয়ে জমি নিতে হয়েছে। রাজ্যের অভিযোগ ছিল, সরকারের কাছে টাটাদের কোনও আবেদন না থাকা সত্ত্বেও ওই সংস্থাকে যথেচ্ছ ভাবে জমি পাইয়ে দেওয়া হয়েছে। বিচারপতি অরুণকুমার মিশ্র এ দিন জানতে চান, অটোমোবাইল হাব গড়া নিয়ে টাটারা রাজ্যের কাছে কোনও ডিটেল প্রজেক্ট রিপোর্ট (ডিপিআর) জমা দিয়েছিল কিনা। তখন রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম বার ওই ডিপিআর আদালতে জমা দেওয়া হয়। রাজ্য সরকার দু’পাতার ডিপিআরটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে না চাইলেও, আদালতের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বোঝা যাচ্ছে যে শিল্পের জন্যই সিঙ্গুরে জমি নেওয়া হয়েছিল। রাজ্য বিধানসভার শিল্প বিষয়ক স্থায়ী কমিটিও সিঙ্গুরে শিল্প গড়তে রিপোর্ট দিয়েছিল। এ সবের মধ্যেই রাজ্য মন্ত্রিসভা সেখানকার জমিটি বেছে নেয়। আগামিকাল এই মামলার চূড়ান্ত শুনানি হওয়ার কথা। আজ বিচারপতি ভি গোপালগৌড়া জানান, আগামিকাল দু’পক্ষকেই বলার সুযোগ দেবে আদালত। তার পরেই শীর্ষ আদালত এই মামলায় রায় দেয় নাকি তা স্থগিত রাখে, এখন সেটাই দেখার।