গরমে শুকিয়ে গিয়েছে মালবাজারের একটি চা বাগানের চা পাতা।
দিনে যতই গরম থাকুক, রাত নামলে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি! কয়েক বছর আগেও শিলিগুড়ির গ্রীষ্মকাল মানেই ছিল এমন একটা ধারণা। কিন্তু, এমন মনোরম শিলিগুড়ি যে আর নেই তা যেন স্পষ্ট করে দিচ্ছে জুলাই শেষের ঝলসানো আবহাওয়া। প্রবল দাবদাহে পুড়ছে জলপাইগুড়ি, কোচবিহারও। এমনকী, দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াঙেও শান্তি নেই। শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ির সর্বোচ্চ তাপমাত্রা তো মঙ্গলবার ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গিয়েছে। গরম বাতাসের ধাক্কায় দিনভর তো বটেই, রাত ৯টা পর্যন্ত নাকাল হয়েছেন শহরবাসী। পুড়ে যাচ্ছে চা বাগান। তামাটে হয়ে যাচ্ছে সবুজ পাতা। বাড়ছে রোগপোকার দাপটও।
পাহাড়ও তাতছে। কালিম্পঙের সর্বোচ্চ তাপমাত্রাও ছিল ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। দার্জিলিঙে কয়েক পশলা বৃষ্টি হলেও সারাদিনে তাপমাত্রা কিন্তু ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশেই। কার্শিয়াঙেও ছিল চড়া রোদ। কার্শিয়াঙেও কয়েকটি এলাকায় হালকা বৃষ্টি হয়েছে। তাতে খুসির চেয়েও আশঙ্কা জাঁকিয়ে বসেছে বেশি। কারণ, প্রবল গরমের সঙ্গে যদি অল্পস্বল্প বৃষ্টি হয় তাতে ধসপ্রবণ এলাকায় বিপদের আশঙ্কা বেশি বলে ভুক্তভোগী ও প্রবীণ বাসিন্দাদের অনেকের ধারণা। দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি থেকে কোচবিহার, সর্বত্র এখন যেন বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা চলছে।
তবে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিভাগ কিংবা সিকিমের কেন্দ্রীয় আবহাওয়া মন্ত্রকের কোনও বিশেষজ্ঞই কিন্তু চটজলদি পাহাড় ও সমতলে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির আশা দেখছেন না। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের প্রধান সুবীর সরকার জানান, রাজ্যের দক্ষিণ ভাগে মৌসুমী অক্ষরেখা অতি মাত্রায় সক্রিয় থাকায় সেখানে বৃষ্টি হচ্ছে। তবে সেই অক্ষরেখা রাতারাতি সরে উত্তর পানে আসার কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না বলে সুবীরবাবু জানান। তিনি বলেন, ‘‘কোনও অঘটন না ঘটলে আরও দুদিন মানে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এমন রুক্ষ্ম আবহাওয়া সহ্য করতে হবে উত্তরবঙ্গবাসীকে। শুক্র-শনিবারের আগে টানা বৃষ্টির কোনও প্রেক্ষাপট তৈরি হবে বলে মনে হয় না।’’ তবে স্থানীয় নিম্নচাপ কিংবা কোনও অঘটন ঘটলে বৃষ্টির দেখা মেলার সম্ভাবনা রয়েছে বলে সুবীরবাবু মনে করেন।
গরমে শিলিগুড়ির রাস্তায় গলে গিয়েছে পিচ।
কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের তরফেও জানানো হয়েছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টা উত্তরবঙ্গে টানা বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা তেমন নেই। বঙ্গোপসাগরের উপরে একটি এবং রাজস্থানের উপরে আরেকটি নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে। এই দুই নিম্নচাপের মধ্যে দিয়ে মৌসুমী অক্ষরেখা অবস্থান করছে। যা কিনা উত্তরবঙ্গের থেকে অনেকটা নীচে। আবহাওয়াবিদরা অনেকে জানিয়েছেন, যত ক্ষণ পর্যন্ত উত্তরবঙ্গের উপরে নিম্নচাপ ঘনীভূত হয়ে মৌসুমী অক্ষরেখাকে কিছুটা উপর দিকে টেনে না তুলছে, বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। সিকিমের আধিকারিক গোপীনাথ রাহা বলেন, ‘‘সিকিমে গত সোমবার রাতেও কিছুটা বৃষ্টি হয়েছে। মঙ্গলবার তেমন একটা বৃষ্টি হয়নি। তবে আগামী ৪৮ ঘণ্টার পর পরিস্থিতি কিছুটা বদলাতে পারে।’’
দার্জিলিং পাহাড়ের পরিবেশপ্রেমীরাও উদ্বিগ্ন। যেমন, ফেডারেশন অফ সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্টের অধিকর্তা ভরতপ্রকাশ রাই বলেন, ‘‘গত পাঁচ বছরে দার্জিলিঙে বৃষ্টিপাতের ধরন অনেকটাই বদলে গিয়েছে। সম্ভবত বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবেই দার্জিলিঙে বৃষ্টি কমেছে। বেশ কয়েক বছর আগেও বর্ষার সময়ে টানা বৃষ্টি হতো পাহাড়ে। এখন বর্ষার বেশিরভাগ দিনই রোদ ঝলমলে থাকছে। মাঝেমধ্যে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে।’’ ভরতবাবুর আশঙ্কা, এই ধরনের আবহাওয়ায় ধসের প্রবণতা বাড়ে। তাঁর কথায়, ‘‘দিনে রোদ এবং বৃষ্টি দুই-ই চলতে থাকলে ধসের আশঙ্কা বেড়ে যায়।’’ তিন দিনের মধ্যে সোমবার বিকেলেই দার্জিলিঙে বিক্ষিপ্ত ভাবে বৃষ্টি হয়েছিল। এ দিন আকাশে মেঘ থাকলেও, বৃষ্টি হয়নি।
গরমের দুপুরে জলপাইগুড়িতে।
ডুয়ার্সের ওদলাবাড়ি এবং ডামডিমের মাঝে থাকা রানিচেরা চা বাগানের ম্যানেজার তথা টি অ্যাসোসিয়েশেন অব ইন্ডিয়ার কর্মকর্তা অনির্বাণ মজুমদারের কথায়, ‘‘চা গাছ ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতায় বেড়ে উঠতে পারে। কিন্তু তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পেরোলেই সালোকসংশ্লেষ বন্ধ হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে চা গাছের বৃদ্ধিও থমকে যায়। এখন তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছে যাওয়ায় চা গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়ে পড়েছে। নতুন পাতা আসাও একপ্রকার বন্ধ হয়েছে। এরকম রোদ যদি না কমে তা হলে সমূহ বিপদ।’’ বড়দিঘি চা বাগানের ম্যানেজার তথা ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশন বা ডিবিআইটিএ এর চালসা শাখার চেয়ারম্যান ইন্দ্রজিৎ সিংহ চহ্বান বলেন, ‘‘এমন ঝলসানো আবহাওয়া চললে অনেক জায়গায় চায়ের গুণগত মান বজায় রাখা সমস্যা হয়ে যেতে পারে।’’
মঙ্গলবার ছবি দুটি তুলেছেন বিশ্বরূপ বসাক ও সব্যসাচী ঘোষ।