WB CPM

সিপিএমে অন্য ‘গ্লাসনস্ত’, ‘পেরেস্ত্রৈকা’! এক বছরে তিন ঘটনায় খোলা হাওয়া ও সংস্কারের সঙ্কেত স্পষ্ট

মানবাধিকার এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তি স্বাধীনতা ছিল ‘গ্লাসনস্ত’-এর অন্যতম উদ্দেশ্য। তার সঙ্গেই জুড়ে ছিল ব্যক্তি পরিচয়কে প্রতিষ্ঠা দেওয়া। আর ‘পেরেস্ত্রৈকা’র অর্থ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংস্কার।

Advertisement

শোভন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৯:৫৫
Share:
Signs of reform and openness within the state CPM are evident in several incidents

সোভিয়েতের উল্টো প্রেক্ষাপটে বাংলার ‘গ্লাসনস্ত’ এবং ‘পেরেস্ত্রৈকা’। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

একটা সময়ে বাংলার বামেরা সোভিয়েতের স্বপ্ন ফেরি করতেন। তিন দশক হয়ে গেল সে সবের সুযোগ নেই। সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার আগে মিখাইল গোর্বাচেভ দু’টি নীতি কার্যকর করেছিলেন— ‘গ্লাসনস্ত’ (খোলা হাওয়া) এবং ‘পেরেস্ত্রৈকা’ (সংস্কার)। যে দু’টি নীতিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘কফিনে শেষ পেরেক’ হিসাবে দেখেন অনেকে। বাংলায় সিপিএমের ‘বার্লিন প্রাচীর’ ভেঙে গিয়েছে অনেক দিন। সিপিএম ক্ষমতা থেকে চলে গিয়েছে ১৪ বছর আগে। দল এখন প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত। পরিস্থিতি যখন এমনই, তখন বঙ্গ সিপিএমেও ‘মুক্ত হাওয়া’ এবং ‘সংস্কার’ মডেল প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। গত এক বছরে ঘটে যাওয়া তিনটি ঘটনাকে এর সূচক বলে দলেরই অন্দরে অনেকে মনে করছেন।

Advertisement

মানবাধিকার এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তি স্বাধীনতা ছিল ‘গ্লাসনস্ত’-এর অন্যতম উদ্দেশ্য। তার সঙ্গেই জুড়ে ছিল ব্যক্তি পরিচয়কে প্রতিষ্ঠা দেওয়া। আর ‘পেরেস্ত্রৈকা’র অর্থ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংস্কার। সিপিএম এখন ক্ষমতায় নেই। তাই সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের সংস্কারের সুযোগও নেই। তবে সাংগঠনিক ক্ষেত্রে সংস্কারের বার্তার অবকাশ রয়েছে।

কয়েক বছর আগেও যখন বামেদের প্রশ্ন করা হত, তাদের ‘মুখ’ কে, পিন আটকে-যাওয়া রেকর্ডের মতো সব নেতাই অভিন্ন বাক্য বলতেন— ‘‘বামপন্থীদের কোনও মুখ হয় না। মতাদর্শই শেষ কথা।’’ দেরিতে হলেও সিপিএম বুঝেছে ‘মুখ’ দরকার। বিশেষত সংসদীয় রাজনীতিতে তো দরকার বটেই। সে কারণেই গত বছর থেকে রাজ্য সিপিএমের প্রথম সারির নেতারা প্রকাশ্যেই মেনে নিতে থাকেন আপাতত দলের ‘মুখ’ মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। যে প্রয়াসকে অনেকে ব্যক্তি পরিচয়ের প্রতিষ্ঠা দেওয়ার ‘গ্লাসনস্তীয়’ দৃষ্টিভঙ্গি হিসাবে দেখতে চেয়েছেন। আলিমুদ্দিন স্ট্রিট অবশ্য সেই ‘অভিশপ্ত’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করতে নারাজ। তাদের বক্তব্য, এটা ‘নতুন সিপিএম’। তবে রেওয়াজ যে নতুন, আগে যে তা ছিল না, তা মানতে কারও আপত্তি নেই।

Advertisement

সোভিয়েতের পতন নিয়ে একাধিক গবেষণাপত্রে উল্লেখ রয়েছে এই মর্মে যে, ১৯৯০ সালে গোর্বাচেভ ‘গ্লাসনস্ত’ এবং ‘পেরেস্ত্রৈকা’ বলবৎ করলেও সেই হাওয়া বইতে শুরু করেছিল ১৯৮৬ সাল থেকেই। সিপিএমের এক নেতার বক্তব্য, ‘‘এখানেও কয়েক বছর ধরে সেই হাওয়া বইছে। না হলে ‘টুম্পাসোনা’র প্যারডি গাওয়া হয়! সেটাও তো ছিল এক ধরনের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা!’’

দলের কাজের ধারাতেও নিঃশব্দে সংস্কার ঘটিয়ে ফেলেছে সিপিএম। গত নভেম্বরে রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম ফেসবুকে ‘লোক খুঁজছি’ মর্মে একটি পোস্ট করেছিলেন। তাতে বেশ কয়েকটি পদে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোক নিয়োগের কথা বলা হয়েছিল। ঘটনাচক্রে, প্রথম পদটিই ছিল রাজনৈতিক বিশ্লেষকের। অর্থাৎ, পরিস্থিতি বুঝে যিনি পরামর্শ দেবেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ছাড়াও গণজ্ঞাপনে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লেখার লোক, গ্রাফিক ডিজ়াইনার, ডিজিটাল বিপণনের জন্য এগ্‌জ়িকিউটিভ নিয়োগের বিজ্ঞাপনও ছিল সেই পোস্টে। সিপিএম সূত্রে খবর, সেই নিয়োগ ইতিমধ্যেই সেরে ফেলেছে দল। আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের অদূরেই একটি বাড়িতে বসে সেই ‘টিম’ নানাবিধ কাজও শুরু করে দিয়েছে।

সর্বশেষ ‘খোলা হাওয়া’ বয়ে গেল উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্মেলনে। যেখানে রাজ্য সিপিএমকে কার্যত নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছেন জেলার প্রতিনিধিরা। ‘চাপিয়ে’ দেওয়ার কৌশল ভেস্তে গিয়েছে সেই জেলায়। দেখা গিয়েছে, ভোটাভুটিতে হেরে জেলা কমিটি থেকেই ছিটকে গিয়েছেন বিদায়ী জেলা সম্পাদক মৃণাল চক্রবর্তী। সিপিএমে গুঞ্জন ছিল, চার-পাঁচ জন দাবিদারকে ঠেকাতে এ বারেও ‘ভারসাম্য’ রক্ষা করতে মৃণালকে সম্পাদক করা হবে। কিন্তু সেই সুযোগই রাখেননি জেলার নেতারা। হেরে গিয়েছেন মৃণাল। সিপিএম সূত্রের খবর, উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্মেলনে একাধিক প্রতিনিধি নেতৃত্বের সামনে এমন এমন ‘বিশেষণ’ ব্যবহার করেছেন, যা অভাবনীয়! সূত্রের আরও খবর, সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের উপর আলোচনার সময়ে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের এক নেতা দল সম্পর্কে ‘বিশেষ বিশেষণ’ ব্যবহার করেন। শুনেই চিৎকার করে ওঠেন এক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। কিন্তু পাল্টা চিৎকারও শুনতে হয় তাঁকে। বিষয়টি দলের জন্য ভাল না মন্দ, তা নিয়ে নানা মত থাকলেও সকলেই মানছেন, এ-ও এক ধরনের ‘খোলা হাওয়া’ই বটে। তবে এই খোলা হাওয়া বয়ে যাওয়া কিংবা সংস্কার— সবই হচ্ছে সোভিয়েতের উল্টো প্রেক্ষিতে। সোভিয়েত টিকে থাকা অবস্থায় কার্যকর হয়েছিল ‘গ্লাসনস্ত’ এবং ‘পেরেস্ত্রৈকা’। তার পরে সেই বিপ্লবের সৌধ ভেঙে পড়েছিল। বাংলায় সিপিএমের এখন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই। প্রান্তিক শক্তি থেকে দৃশ্যমান হওয়ার লড়াই।

‘খোলা হাওয়া’ কি লাগবে সিপিএমের পালে? জবাব দেবে ২০২৬।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement