অযত্নে সেই ফলক। নিজস্ব চিত্র
সিধো, কানহুর স্মৃতিফলক কোথায় আছে?
প্রশ্নটা শুনেই থমকে দাঁড়ালেন বৃদ্ধ বিনয় চৌধুরী। খানিক স্মৃতি হাতড়ে বললেন, ‘‘এই ধর্মতলা চত্বরেই তো ছিল। আগে যাতায়াতের পথে দেখতে পেতাম। এখন কি আর ও সব আছে?’’
কলেজ পডুয়া তরুণ অবশ্য জানেনই না, এমন কোনও স্মৃতি ফলক আদৌ আছে কি না। অনেকেরই স্মৃতিতে নেই সেই ফলকের কথা। কারণ, শহরের প্রাণ কেন্দ্র ধর্মতলার এক ফুটপাতে দখলদারির আড়ালেই দিন কাটছে সাঁওতাল বিদ্রোহের দুই নেতা সিধো, কানহুর। কখনও বাস দাঁড়িয়ে আড়াল হয়ে থাকছে, কখনও আবার ফুটপাতে বসা দোকানের জন্য রাস্তা থেকে কারও চোখেই পড়ে না সেই স্মৃতিফলক। পথচারীদের একাংশের দাবি, ‘‘এমন ঘিঞ্জি ফুটপাতে কোনও ফলক থাকলে কারও নজরে আসা সহজ নয়।’’
দোকানের আড়ালে চলে গিয়েছে স্মৃতিফলক। নিজস্ব চিত্র
বিষয়টি জেনে আক্ষেপ প্রকাশ করেন সাঁওতালদের সর্বভারতীয় সামাজিক সংগঠন ‘ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহলের’ দুই মেদিনীপুরের নেতা শিবশঙ্কর সোরেন। বললেন, ‘‘মনে হয় আমরা পিছিয়ে থাকা জনজাতি বলেই কারও নজরে আসি না। ধর্মতলা কিংবা ময়দান চত্বরে সিধো, কানহুর স্মৃতি স্তম্ভ তৈরির জন্য আবেদন জানালেও, কিছু হয়নি। আর স্মৃতি ফলকও ফুটপাতে অবহেলায় লুকিয়ে রয়েছে।’’
ধর্মতলার টিপু সুলতান মসজিদের দিক থেকে রাজভবন যাওয়ার রাস্তার ডান দিকের ফুটপাতে ৬ এসপ্লানেড ইস্ট ঠিকানার বাড়ির সামনেই রয়েছে প্রায় পাঁচ ফুট উচ্চতার ওই ফলক। উল্টো দিকে রয়েছে সিটিসি বাসস্ট্যান্ড। কংক্রিটের বেদির উপরে বসানো ওই ফলকের উপরই প্লাস্টিকের ছাউনি টাঙিয়ে চারপাশে বসেছে বিভিন্ন দোকান। এক দোকানদার বলেন, ‘‘আগে ৩০ জুন অনুষ্ঠান হত। এখন তেমন কিছুই হয় না।’’
১৯৮৩ সালের ৩০ জুন সিধো ও কানহুর স্মৃতি রক্ষার্থে ধর্মতলার ওই জনপথ উন্মোচিত করেছিলেন তৎকালীন পুর উন্নয়ন মন্ত্রী প্রশান্ত শূর। তখনই বসানো হয়েছিল ওই সিধো কানহু ডহর (সাঁওতাল ভাষায় ডহর শব্দের অর্থ পথ) নামাঙ্কিত ফলকটি। ইতিহাসবিদেরা জানাচ্ছেন, ধর্মতলার ওই জায়গার সঙ্গে সিধো, কানহুর সরাসরি যোগ নেই। পাশাপাশি তাঁরা জানাচ্ছেন, ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন প্রায় তিরিশ হাজার সাঁওতাল কৃষক বীরভূমের ভগনাডিহি গ্রাম থেকে কলকাতার দিকে পদযাত্রা শুরু করেছিলেন। যদিও কিছু পথ এগোনোর পরে ব্রিটিশ সৈন্য পথ আটকানোয় তাঁদের আর কলকাতায় পৌঁছনো হয়নি।
তাহলে ধর্মতলার ওই ফুটপাথে ফলক বসেছিল কেন?
তৎকালীন আদিবাসী কল্যাণ মন্ত্রী শম্ভুনাথ মান্ডি বলেন, ‘‘আদিবাসী সংগঠনের সিদ্ধান্ত মেনে ওই জায়গায় বসানো হয়েছিল।’’ ৩৬ বছর আগে ওই ফলক বসানোর অনুষ্ঠানে ‘রসিকা মান্ডুয়া’-র (শিল্পী তীর্থ) হয়ে গাইতে আসা শিল্পী সুখচাঁদ সোরেন বলেন, ‘‘কলকাতায় বড়লাটের সঙ্গে দেখা করার জন্য সাঁওতাল কৃষকেরা পদযাত্রা শুরু করেছিলেন। সেই স্মৃতিকে সম্মান জানাতে স্বাধীন ভারতে পশ্চিমঙ্গের রাজ্যপালের বাসভবনের গেটের সোজা রাস্তায় ওই স্মৃতি ফলক বসানো হয়েছিল।’’ তাঁর আক্ষেপ, ‘‘কলকাতায় গেলে দেখি, ফলকটা ত্রিপল আর দোকানে ঢাকা পড়েছে।’’
রাজ্যের আদিবাসী উন্নয়নমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এক মাস হল দায়িত্বে এসেছি। ওই ফলকের বিষয়টি খোঁজ নিয়ে, যতটুকু করার নিশ্চয় করা হবে। সাঁওতাল বিদ্রোহের স্মৃতিকে সম্মান জানাতে মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যেই সিধো, কানহুর মূর্তি বসানোয় উদ্যোগী হয়েছেন।’’