প্রতিবাদ মিছিলে এলাকার মহিলারা। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
প্রতিবাদ-বিক্ষোভের সঙ্গে আতঙ্কও ঘিরে রয়েছে বামনগাছি জুড়ে। বদলার আতঙ্ক। তাই শ্যামল কর্মকারের মদতকারী হিসেবে তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্যের দিকে আঙুল তোলার পরেও থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করতে গিয়ে পিছিয়ে আসেন এলাকার বাসিন্দারা। তাই নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে এ দিন বিকেলে এলাকার মহিলারা ফের পথে নামার এবং রাতে শ্যামলের দুই সঙ্গীকে তাড়া করে এলাকা ছাড়া করার পরেও ওঠে প্রশ্ন, দু’চার দিন পরে সব ঠান্ডা হয়ে গেলে ওরা বদলা নিতে ফিরে আসবে না তো?
আতঙ্কের যে কারণ রয়েছে, তার প্রমাণ মিলেছে সোমবার রাত ন’টা নাগাদ। এলাকায় পুলিশি পাহারা আছে। তা এড়িয়েই কিন্তু রাতে সেখানে ঢুকে পড়ে শ্যামলের সঙ্গী দুই যুবক। সারা দিন বিক্ষোভ মিছিলে ব্যস্ত থেকে বামনগাছির বাসিন্দারা তখন ঘরে ফিরেছেন। কিন্তু খবর পেয়েই বেরিয়ে এলেন মহিলা-পুরুষ সকলে। তাড়া করে এলাকা ছাড়া করা হল ওই যুবকদের। এলাকার বাসিন্দাদের অনেকেই বললেন, “বিপদ বাড়ছে। পুলিশ তো থেকেও নেই। এখন সতর্ক থাকতে হবে সবাইকে।”
সৌরভ খুনের মূল অভিযুক্ত শ্যামল কর্মকার এখনও অধরা। অধরা তার মদতদাতারাও। ছয় অভিযুক্তের গ্রেফতারের পরেও তাই নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা কাটছে না বামনগাছির। বিকেলে প্রতিবাদ মিছিলে এলাকার মহিলারা এই আতঙ্কের প্রসঙ্গই তুলেছিলেন। সরব হয়েছিলেন এলাকার দুষ্কৃতী এবং তাদের মদতদাতাদের বিরুদ্ধে। বলেছেন, “এই নেতাদের মদত না পেলে শ্যামলরা এত বাড়তে পারত না।”
তাঁদের বক্তব্য, মদতদাতা নেতাদের জেলে না পুরলে আবার নতুন শ্যামল জন্মাবে। নতুন করে আতঙ্ক তৈরি করবে এলাকায়। প্রতিবাদ করতে গিয়ে ফের প্রাণ যাবে আরও কোনও সৌরভের। সৌরভের মা মিতা চৌধুরীও বলেন, “আর কত মায়ের কোল খালি হবে জানি না! আমার বড় ছেলেটারও যে কী হবে, কে জানে!” এলাকার মহিলারা বলছেন, “এই নিরাপত্তাহীনতাই আমাদের পথে নামতে বাধ্য করেছে। রাতেও আমরা সতর্ক থাকছি। মদতদাতাদের পিছনে যে রয়েছে শাসক দলের একাংশ!”
শ্যামলের পিছনে শাসক দলের মদতের এই অভিযোগ অবশ্য গোড়া থেকেই উঠেছিল। এ দিনও থানায় গিয়ে স্থানীয় তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য তুষার মজুমদার ওরফে বিশুর বিরুদ্ধে শ্যামলকে মদত দেওয়ার অভিযোগ করেন সৌরভের দাদা সন্দীপ। কিন্তু লিখিত অভিযোগ দায়ের করতে ভয় পাচ্ছিলেন তাঁরা। তাঁদের বক্তব্য, লিখিত অভিযোগ করলে ওই এলাকার বাসিন্দাদের নতুন করে আতঙ্কের মোকাবিলা করতে হবে। হেনস্থারও শিকার হতে হবে তাঁদের।
কেন?
বাসিন্দারা বলছেন, শ্যামলদের এই দৌরাত্ম্যের কথা বারবারই জানানো হয়েছে পুলিশ ও স্থানীয় নেতাদের। কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টে জনরোষের হাত থেকে বাঁচাতে স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য তুষারবাবু কার্যত শ্যামলের অভিভাবকের ভূমিকা নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। পুলিশও শ্যামলের রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা জানার ফলে তাকে খুব একটা ঘাঁটাত না বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান। এই প্রসঙ্গেই কুলবেড়িয়ার এক মহিলা বলেন, “এই তো পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা! এর পরে কার উপরে আস্থা রাখব!”
বামনগাছির বাসিন্দারা জানালেন, এলাকায় দুষ্কৃতী তাণ্ডব অবশ্য বাম আমল থেকেই। স্থানীয় এক প্রৌঢ় বলছিলেন, তখনও চলত চোলাই-জুয়ার ঠেক। এবং তখনও পুলিশ এলাকার মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি, এখনও পারছে না। স্থানীয়দের একাংশের বক্তব্য, বামনগাছিতে এর আগেও গোলমাল হয়েছে। সৌরভ খুনের মূল অভিযুক্ত শ্যামলও বেশ কয়েক বার জেল খেটে এসেছে। “কিন্তু তার পরেও নিরাপত্তা বেড়েছে কি,” প্রশ্ন সৌরভের এক বন্ধুর।
পুলিশ অবশ্য এ দিন সন্দীপদের আশ্বাস দিয়েছে, অভিযোগ করলে নিরাপত্তা মিলবে। সন্দীপ বলেন, পুলিশ যদি নিরাপত্তা দিত, তা হলে তো এত কাণ্ড ঘটত না। একই সঙ্গে অভিযোগ করা হয়, যে চোলাই ঠেক-সহ যাবতীয় অসামাজিক কাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে সৌরভকে খুন হতে হল,তা এখনও রমরম করে চলছে। এলাকায় পুলিশ মোতায়েন থাকা সত্ত্বেও রবিবার রাতে বামনগাছির নানা প্রান্তে চোলাই-জুয়ার আড্ডা বসেছে বলে অভিযোগ।
পুলিশের এই নিষ্ক্রিয় মনোভাব নিয়ে ইতিমধ্যেই সরব নিহতের পরিবার। তাঁদের দাবি, এই মর্মান্তিক খুনের ঘটনায় সিবিআই তদন্ত করতে হবে। একই সুর রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের গলায়। বিজেপি রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহও সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়ে বলেন, “বারাসতের পুলিশি ব্যবস্থা নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে চিঠি পাঠাচ্ছি।”
প্রতিবাদ হয়েছে এ দিন বিধানসভাতেও। প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানিয়ে এ দিন সিপিএম-কংগ্রেস ওয়াকআউট করে। শেষ পর্যন্ত বেলা ১২টা ১২ মিনিটে সভা মুলতুবি করে দেন স্পিকার।