আবেগের সন্ধ্যা, এ বারের সেরার সেরা শীর্ষেন্দু

এই মজাদার প্রৌঢ়ই এ বার সেরার সেরা বাঙালি— শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। সম্ভবত বাজারহাট, শপিং মলে, আড্ডায় আজও তাঁর কাঁধে ‘গোঁসাইবাগানের ভূত’ নিধিরাম ভর করে।

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০১৯ ০৩:৪৭
Share:

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন কৃষ্ণা বসু। ছবি: রণজিৎ নন্দী

কয়েক বছর আগে এক প্রৌঢ় তাঁর পুত্র ও পুত্রবধূকে নিয়ে দক্ষিণ কলকাতার এক অভিজাত শপিং মল থেকে ফিরছিলেন। শশব্যস্ত হয়ে ছুটে এলেন আর এক ভদ্রলোক, ‘‘আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি! সিরিয়াল করেন, না?’’ প্রৌঢ় মৃদু হাসলেন, ‘‘না, ইচ্ছে তো ছিল। কিন্তু এখনও সুযোগ পাইনি।’’

Advertisement

এই মজাদার প্রৌঢ়ই এ বার সেরার সেরা বাঙালি— শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। সম্ভবত বাজারহাট, শপিং মলে, আড্ডায় আজও তাঁর কাঁধে ‘গোঁসাইবাগানের ভূত’ নিধিরাম ভর করে। এক বার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, এত ভূতের আইডিয়া পান কোথা থেকে? লেখকের সপ্রতিভ উত্তর ছিল, ‘কে জানে! ভূতেরাই দিয়ে যায় বোধ হয়।’ গত কয়েক দশক ধরে পরীক্ষা খারাপ হলেই ছোটদের কানের কাছে কারা যেন গুনগুন করে গিয়েছে, ‘বুরুন, তুমি অঙ্কে তেরো।’

আর বড়রাও তো তাঁর লেখায় প্রথম থেকেই খুঁজে পেয়েছে বুকের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ‘ঘুণপোকা’কে। কখনও বা তারা খুঁজেছে ‘যাও পাখি’র সেই রিখিয়াকে, আসাই পেন্ট্যাক্স ক্যামেরার মতোই জ্বলে ওঠে যার ঝকঝকে চোখ। এ দিনও কৃষ্ণা বসুর হাত থেকে পুরস্কার নিয়ে শীর্ষেন্দু বলছিলেন, ট্র্যাজেডি লিখতে তাঁর মন চায় না। মধ্য কলকাতার পাঁচতারা হোটেলে তখনই পাঠকের মনে পড়ে তাঁর গল্পে মৃত্যুপথযাত্রী ছোটকাকাকে। যিনি চান, কেউ এমন কিছু বলুক, যাতে তিনি সান্ত্বনা পান। সবাই একে একে বলে গেলেন, তোমার ছেলেমেয়েকে নিয়ে ভেবো না, আমরা তো আছি ইত্যাদি। কিন্তু কোথাও সান্ত্বনা মিলল না। অবশেষে তাঁর বাবা এসে বললেন, ‘দেখা হবে।’ সেরার সেরা বাঙালি এ ভাবেই গত কয়েক দশক ধরে আমাদের আশ্বস্ত করে চলেন।

Advertisement

আর, শীর্ষেন্দুর উপন্যাস বেরোনোর আগে, সেই পঞ্চাশের দশকে ‘অগ্নিপরীক্ষা’ থেকেই তিনি বাঙালির হৃদয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছেন ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু!’ শুধু কি সুচিত্রার ঠোঁটে? তাঁর গলাতেই তো প্রাণ পেয়েছিল তনুজার ‘চম্পা চামেলী গোলাপের বাগে’ কিংবা ‘নায়িকা সংবাদ’ ছবিতে অঞ্জনা ভৌমিকের ‘কেন এ হৃদয় চঞ্চল হল।’ প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিভিন্ন নায়িকার ঠোঁটে সঙ্গীতের স্ফুরণ তাঁর কণ্ঠেই। সেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের হাতে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট তুলে দিলেন সন্ধ্যা রায়। দর্শকাসন থেকে সকলে উঠে দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানালেন বর্ষীয়ান গায়িকাকে। দুই সন্ধ্যার মিলনে পাঁচতারা হোটেলে উড়ল স্মৃতির কবুতর। ‘মায়ামৃগ’ ছবিতে নতুন নায়িকা সন্ধ্যা রায়ের কণ্ঠে ‘বকম বকম পায়রা’ তো গেয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ই।

সন্ধ্যা তো উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি, মুনাব্বর খানের কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিখতেন! এ দিনও পুরস্কারমঞ্চ থেকে দর্শকাসনে বসা উস্তাদ রাশিদ খানকে মনে পড়িয়ে দিলেন, রাশিদের দাদু উস্তাদ নিসার হুসেন খানের সামনেও তিনি গেয়েছেন। তার একটু আগেই সঙ্গীতে সেরা বাঙালি হিসাবে উস্তাদ রাশিদ খানের হাতেই সম্মান তুলে দিয়েছেন হৈমন্তী শুক্ল।

একাধিক প্রজন্ম এ ভাবেই একাকার হয়ে গিয়েছে সেরা সন্ধ্যায়। সাহিত্যে সেরা বাঙালি হিসাবে স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর হাতে সম্মান তুলে দিয়েছেন সমরেশ মজুমদার। ভাস্কর বিমল কুণ্ডুর হাতে শিল্পকলায় সেরা বাঙালির সম্মান তুলে দিয়েছেন লালুপ্রসাদ সাউ। প্রবীণের হাতে এ দিন বারে বারেই সম্মানিত হয়েছেন নবীন, অন্তরালে বয়ে গিয়েছে নবসৃষ্টিধারা।

বাণিজ্যে সেরা রণজয় দত্ত। শিলং এবং খড়্গপুর আইআইটি হয়ে আমেরিকায় ইউনাইটেড এয়ারের কর্ণধার। সেই ইউনাইটেড এয়ার, যার দুই যাত্রিবাহী বিমান নিয়ে জঙ্গিরা আছড়ে পড়েছিল নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ারে। তার পর দেশে ফিরে রণজয় প্রথমে সাহারা এয়ারে, এখন ইন্ডিগোর কর্ণধার। কিংফিশার, জেট থেকে এয়ার ইন্ডিয়া সকলে যখন প্রায় ভূমিশয্যায়, রণজয়ের ইন্ডিগো এ দেশের উড়ান-বাণিজ্যে উজ্জ্বল।

সৃষ্টি আর স্রষ্টাও এই সন্ধ্যায় একাকার। দেবশঙ্কর হালদার নাট্যকলায় সেরা বাঙালির পুরস্কার তুলে দিয়েছেন ব্রাত্য বসুর হাতে। দেবশঙ্করই তো ব্রাত্যর ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ থেকে ‘রুদ্ধসংগীত’, ‘বোমা’— বহু নাটকে অভিনয়ের প্রাণপ্রতিষ্ঠাতা। ঝুলন গোস্বামী সেরা বাঙালি ক্রীড়াবিদের সম্মান তুলে দিয়েছেন অলিম্পিক-খ্যাত দীপা কর্মকারের হাতে। সেরা অভিনেতা আবীর চট্টোপাধ্যায়। তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। পর্দায় আছড়ে পড়েছে ফেলুদা, ব্যোমকেশের চলচ্ছবি। দেখা গিয়েছে দুর্গেশগড়ের সোনাদাকেও। সঞ্চালকরা জানালেন, বাংলা ছবিতে গোয়েন্দা মানেই এখন আবীর।

দর্শকাসনে তখন নীরবে বসে সেরার সেরা বাঙালি। তাঁর গল্পের মোড়কেই বাংলা সিনেমা প্রাইভেট ডিটেকটিভের গণ্ডি ছাড়িয়ে পেয়েছে এক পুলিশ গোয়েন্দাকেও...শবর দাশগুপ্ত!

অনুষ্ঠানের শুরুতে ছিল তারুণ্যের জয়গাথা। রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করলেন শৌনক চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু তিরিশের দশকে জন্মানো দুই প্রবীণ শীর্ষেন্দু আর সন্ধ্যাতেই ছিল অনুষ্ঠানের উজ্জ্বল উদ্ধার। কে বলে, ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস নাই’!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement