স্বপ্ন ছিল বন্ধুর, শিক্ষিকাই হবো

বসিরহাট হাসপাতালে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে এ ক’দিন যত বার জিজ্ঞাসা করেছি সুহানার কথা, কেউ না কেউ বলেছে, ও ভাল আছে। বাড়ি ফিরেছে। রবিবার হাসপাতাল থেকে ফিরে যখন খবরটা পেলাম, জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যাই। সুহানার সঙ্গে আমার ছোট্টবেলার বন্ধুত্ব। স্বরূপনগরের তেঁতুলিয়ার ভোগলবাড়ি গ্রামে পাশাপাশিই থাকতাম। এক সঙ্গে স্কুলে যেতাম, খেলা করতাম। ওদের আর্থিক অবস্থা ভাল। বাবা সরকারি চাকরি করেন। আর আমাদের তো নুন আনতে পান্তা ফুরোয় দশা।

Advertisement

সেলিমা খাতুন (সুহানা খাতুনের বন্ধু)

শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:০৩
Share:

এসএসকেএম সুপারের ঘরের সামনে ধর্না সুহানার বাবার। নিজস্ব চিত্র

বসিরহাট হাসপাতালে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে এ ক’দিন যত বার জিজ্ঞাসা করেছি সুহানার কথা, কেউ না কেউ বলেছে, ও ভাল আছে। বাড়ি ফিরেছে। রবিবার হাসপাতাল থেকে ফিরে যখন খবরটা পেলাম, জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যাই।

Advertisement

সুহানার সঙ্গে আমার ছোট্টবেলার বন্ধুত্ব। স্বরূপনগরের তেঁতুলিয়ার ভোগলবাড়ি গ্রামে পাশাপাশিই থাকতাম। এক সঙ্গে স্কুলে যেতাম, খেলা করতাম। ওদের আর্থিক অবস্থা ভাল। বাবা সরকারি চাকরি করেন। আর আমাদের তো নুন আনতে পান্তা ফুরোয় দশা। কিন্তু এই তফাতটা ও কখনও বুঝতে দিত না। বরং তেঁতুলিয়া গার্লস হাইস্কুলের ক্লাসরুমে বসে সব সময় নিজের টিফিন আমাকে ভাগ দিয়ে খেত। বলত, ভাল করে খাওয়া-দাওয়া কর। শরীরটা ভাল না রাখলে পড়াশোনা করে জীবনে এগোবি কী করে? মাত্র তো ক্লাস নাইনে পড়তাম দু’জনে। কিন্তু ওর এ সব কথা শুনে মনে হত, যেন বাড়ির বড় কেউ কথা বলছেন।

২৫ নভেম্বর স্কুলে ভৌতবিজ্ঞান পরীক্ষার পরে দুপুরের দিকে দু’জনে হেঁটেই বাড়ি ফিরছিলাম। পর দিন ভূগোল পরীক্ষা ছিল। পড়াশোনা নিয়েই কথা হচ্ছিল। রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম দু’জন। হঠাৎ পিছন থেকে একটা ভ্যানো (ইঞ্জিনচালিত ভ্যান) ধাক্কা মারল আমাদের। ভ্যানটা আমার গায়ের উপর দিয়ে চলে গেল। আর কিছু মনে নেই। চোখ খুলে বুঝলাম, হাসপাতালে শুয়ে আছি। সারা গায়ে অসহ্য ব্যথা। বার কয়েক বমি করলাম। কিন্তু সুহানার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। বাড়ি ফিরে শুনলাম সব কথা। জানতে পারলাম, ওর হাতে রড ঢুকে গিয়েছিল। প্রচুর রক্ত বেরিয়েছিল। তাই কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। এসএসকেএম হাসপাতালে অপারেশনও হয়েছিল। ডাক্তারবাবুরা বলেছিলেন, রক্ত দিতে হবে। রক্ত জোগাড়ও করেন বাড়ির লোকজন। সব পড়ে থেকে নষ্ট হল। ধুঁকতে ধুঁকতে বৃহস্পতিবার মারা গেল আমার বন্ধু।

Advertisement

শুনলাম, ওর বাড়ির লোকজন কলকাতার ভবানীপুর থানায় নালিশ জানিয়েছেন হাসপাতালের বিরুদ্ধে। অভিযুক্ত চিকিৎসক-নার্সের শাস্তি চেয়ে পোস্টার সাঁটানো হয়েছে নানা দিকে। শুক্রবার তেঁতুলিয়ায় রাস্তা অবরোধ করেন পাড়া-প্রতিবেশীরা। কিন্তু তাতে আর কী হবে, সুহানা তো ফিরবে না।

কায়ুম মণ্ডল নামে যে ভ্যান চালকের ধাক্কায় প্রাণ গেল আমার বন্ধুর, তাঁকে ওই দিনই ধরে ফেলে গ্রামের লোকজন। কিন্তু আমাদের দু’জনের চিকিৎসা শুরু হওয়ার পরে নিশ্চিন্ত হয়ে কায়ুমকে পুলিশের হাতে তুলে না দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। ওই চালকের উপরে আমার কোনও রাগ নেই। তিনিও তো গরিব মানুষ। ওঁকে পুলিশে ধরলে তো পরিবারটা পথে বসবে। কিন্তু এ বার যেন ভ্যান চালকেরা আর একটু সাবধানী হন।

সুহানার খুব ইচ্ছে ছিল, বড় হয়ে স্কুলে পড়াবে। আমিও তাই ভেবেছি। এই নিয়ে কত কথা হত দু’জনের। ওর স্বপ্ন এখন আমাকেই সার্থক করতে হবে। শিক্ষক হয়ে ছোট ছেলেমেয়েদের বোঝাব, মানুষের পাশে দাঁড়াতে। যে চিকিৎসক-নার্সের গাফিলতিতে মরতে হল সুহানাকে, তারা যদি নিজের দায়িত্বটুকু পালন করতেন, তা হলে এমন দিন দেখতে হত না। এ সবই শেখাব। আমি জানি, তাতেই শান্তি পাবে আমার বন্ধু সুহানা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement