বাড়ির উপর ভেঙে পড়েছে বিশাল গাছ। ছবি: সজলকুমার চট্টোপাধ্যায়
তখন ফুঁসছে নদী। উথালপাথাল সব কিছু। মোবাইলে হঠাৎ মেসেজ এল ক্লাস সিক্সের ছাত্রী রূপসা মণ্ডলের। লিখেছে, ‘স্যর, আমরা খুব খারাপ অবস্থায় আছি। ঘরটা যে কোনও সময়ে ভেঙে পড়তে পারে।’’
বুক কেঁপে উঠল। ফোন করলাম। রূপসার বাবা ফোন ধরে বললেন, ‘‘আমরা পরিবারের তিন জন ছোট্ট একটা বাথরুমের মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে আছি। বাথরুমটুকু পাকা গাঁথনির। তবে ঘর যে কোনও সময়ে ভেঙে পড়তে পারে।’’
নদীর ধারেই ওদের বাড়ি। দিশাহারা লাগছিল শুনে। প্রশাসনের এক কর্তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, হিঙ্গলগঞ্জে ঝড়ের গতিবেগ ১৪০ কিলোমিটার। তিনি জানালেন, বাইরে বেরোনো সম্ভব নয়। তবে পরিস্থিতি একটু নিয়ন্ত্রণে এলে স্থানীয় রিলিফ টিমের সঙ্গে কথা বলবেন।
আমাদের স্কুলবাড়ি ‘রিলিফ সেন্টার’-এর তালিকায় ছিল না। তবু বেলা ৩টের মধ্যে সেখানে হাজির প্রায় ২০০ জন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাক্ষী থাকার অতীত অভিজ্ঞতা আছে। তাই স্কুলে আগাম ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
বিকেল ৪টের মধ্যেই ঝড়ের দাপটে বিধ্বস্ত এলাকা। গাছের ডাল ভেঙেচুরে, টালি-অ্যাসবেস্টসের ছাউনি গুঁড়িয়ে যেতে শুরু করল। শেকড়সুদ্ধ উপড়ে গেল বহু গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি। ঝড়ের এই প্রলয় নাচন প্রথম দেখছেন না এখানকার মানুষ। তাঁদের মূল ভয়টা দুর্বল নদীবাঁধ নিয়ে।
মোবাইলের টাওয়ার আসছে-যাচ্ছে। তারই মধ্যে খবর পাচ্ছি, পুঁটিয়ারচক, সাঁতরা অঞ্চলে বাঁধ ভেঙেছে। সন্দেশখালি ২ ব্লকের রায়মঙ্গল নদীর জল বাঁধ ছাপিয়ে ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। বিকেলের দিকে ভাটায় নদীর জল নেমে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে জল একটুও সরেনি! যে কয়েক জনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, বাঁধ মেরামতি কেন সময়ে হল না, তা নিয়ে আফসোস সকলের মুখে।
বিকেল গড়িয়ে যত সন্ধ্যা নামছিল, ঝড়ের দাপট বাড়ছিল। হিঙ্গলগঞ্জের শেষ প্রান্ত হেমনগরে থাকেন প্রদীপ মণ্ডল। ফোনে জানালেন, একমাত্র সম্বল মাছধরার ডিঙি নৌকোটা নদীর ধার থেকে তুলে এনে জঙ্গলে বেঁধে রেখেছেন। হিঙ্গলগঞ্জের বাঁকড়া গাবতলা, সাঁতরা, পুটিয়ারচক, পুরাতন ভান্ডারখালি, যোগেশগঞ্জের নটবর ঘাট, সন্দেশখালি শীতলিয়ার নদীবাঁধ ভাঙার খবর আসছিল।
করোনা খাবার কেড়ে নিয়েছে। ঝড় মাথার ছাদ কেড়ে নিল কত মানুষের। সরকারি সাহায্য কবে আসবে, কতটা আসবে— কারও জানা নেই। গোটা হিঙ্গলগঞ্জে হাতে গোনা ছাদ দেওয়া বাড়িগুলি ছাড়া প্রায় সব ক’টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত বা ভূমিসাৎ! গৃহপালিত হাজার হাজার পোষ্য মারা গিয়েছে বলে খবর পাচ্ছি। এর পরেও এটা জাতীয় বিপর্যয় কিনা, সওয়াল-জবাব চলতে থাকবে বিচিত্র এই দেশে!
বারবার ভেঙে পড়া অর্থনীতি শিক্ষায় কতটা নির্মম আঘাত করে, কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। কত ছাত্র হারিয়ে যাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে, এক জন শিক্ষক হিসেবে চোখ বন্ধ করলেই যেন দেখতে পাচ্ছি।
(লেখক: প্রধান শিক্ষক, কনকনগর এসডি ইনস্টিটিউশন)