রিপোর্টে স্পষ্ট খুনের প্রমাণ

রেললাইনে ছুড়ে ফেলা হয় নিথর দেহ

রেললাইনের আশপাশে পড়ে থাকা ছিন্নভিন্ন দেহ দেখেই ইঙ্গিত মিলেছিল, বামনগাছির কলেজছাত্র সৌরভ চৌধুরীকে নৃশংস ভাবে খুন করেছে দুষ্কৃতীরা। সাধারণত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই এ ভাবে খুন করা হয় বলে পুলিশের অভিমত। সোমবার ময়না-তদন্তের পর্যবেক্ষণ সেই মতকেই সমর্থন করল। এনআরএস হাসপাতালের রিপোর্ট বলছে, সৌরভের বুকে-পেটে-পিঠে একাধিক বার ধারালো ছুরি জাতীয় অস্ত্র দিয়ে আঘাতের চিহ্ন মিলেছে।

Advertisement

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য ও কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৪ ০২:৫৩
Share:

অঙ্কন: সুমিত্র বসাক

রেললাইনের আশপাশে পড়ে থাকা ছিন্নভিন্ন দেহ দেখেই ইঙ্গিত মিলেছিল, বামনগাছির কলেজছাত্র সৌরভ চৌধুরীকে নৃশংস ভাবে খুন করেছে দুষ্কৃতীরা। সাধারণত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই এ ভাবে খুন করা হয় বলে পুলিশের অভিমত। সোমবার ময়না-তদন্তের পর্যবেক্ষণ সেই মতকেই সমর্থন করল।

Advertisement

এনআরএস হাসপাতালের রিপোর্ট বলছে, সৌরভের বুকে-পেটে-পিঠে একাধিক বার ধারালো ছুরি জাতীয় অস্ত্র দিয়ে আঘাতের চিহ্ন মিলেছে। চিকিৎসকদের ধারণা, ওই অস্ত্রের আঘাতেই মৃত্যু হয়েছে সৌরভের। সোমবার শিয়ালদহের রেল পুলিশ সুপার উৎপল নস্করও বলেন, “ময়না-তদন্ত রিপোর্টে সৌরভকে খুন করার স্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে বলেই শুনেছি।”

অর্থাৎ ট্রেনের ধাক্কা নয়, সৌরভের মৃত্যু হয়েছে দুষ্কৃতীদের হাতেই।

Advertisement

পুলিশও এ দিন দাবি করেছে, জেরায় ধৃতেরা জানিয়েছে, সৌরভকে খুন করার পরেই অসাড় দেহটা তারা রেললাইনের উপরে ফেলে দিয়েছিল। তাদের চোখের সামনেই তার উপর দিয়ে ট্রেন চলে যায়। ‘শত্রু’র মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরেই তারা এলাকা ছেড়ে যায় বলে পুলিশকে জানিয়েছে ধৃতেরা।

পুলিশের বক্তব্য, শিয়ালদহ থেকে ছেড়ে যাওয়া শুক্রবারের শেষ বনগাঁ লোকাল রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ বামনগাছি পেরিয়েছিল। ওই ট্রেনেই ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল সৌরভের শরীর। কিন্তু রেলের নথি বলছে, শনিবার ভোর ৫টা ৫৫ মিনিটে আপ হাবড়া লোকালে একটি দেহ ট্রেনে কাটা পড়েছে বলে ওই ট্রেনের চালক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন। ফলে ঠিক কখন সৌরভের মৃত্যু হয়েছে, সে নিয়ে এ দিন নতুন করে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।

মূল অভিযুক্ত শ্যামল কর্মকার এখনও অধরা। তা বাদে পুলিশ এ পর্যন্ত ছ’জনকে গ্রেফতার করেছে। ধৃতদের মধ্যে শ্যামলের দিদি পলি মাইতিও আছে। বাকিরা হল অনুপ তালুকদার, উত্তম শিকারি, সুমন সরকার, রতন সমাদ্দার ও তাপস বিশ্বাস। সকলে বামনগাছিরই বাসিন্দা। পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী বলেছেন, “ধৃতেরা খুনের কথা কবুল করেছে। শ্যামলের খোঁজে তল্লাশি চলছে।” পুলিশের অন্য একটি সূত্র দাবি করেছে, এক-দু’দিনের মধ্যেই শ্যামল ধরা পড়বে।

উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ জানাচ্ছে, বামনগাছির যে এলাকায় সৌরভের বাড়ি, সেই কুলবেড়িয়ার ব্যানার্জিপাড়ার এক দল বাসিন্দা রবিবার সকালে শ্যামলের দিদি পলি মাইতির বাড়ি ভাঙচুর করে। পলি তখন নিজেকে নির্দোষ বলেই দাবি করেছিল জনতার কাছে। পুলিশ তখন ওই মহিলাকে নিজেদের ‘আশ্রয়ে’ নিয়ে যায়। জনতার অভিযোগ ছিল, শ্যামল মাঝেমধ্যেই দিদির বাড়িতে রাত কাটায়। ফলে তার গতিবিধি পলি জানে। এর পরে পলিকে জেরা করে পুলিশ। জানা যায়, শুক্রবার একটু বেশি রাতে পলির মোবাইলে ফোন করে একটি গাড়ির ব্যবস্থা করতে বলেছিল শ্যামল। দিদি গাড়ি জোগাড় করে দিলে তাতে চেপেই ওই রাতে পালিয়ে যায় তারা। পলির কথার সূত্র ধরেই সোমবার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে সোদপুরে ঘোলার মুড়াগাছা থেকে চার দুষ্কৃতীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতার করা হয় পলিকেও।

সৌরভের শোকার্ত বাবা-মা। নিজস্ব চিত্র

পুলিশ জেনেছে, ওই রাতে শ্যামল ও তার জনা দশেক শাগরেদ দল বেঁধে ব্যানার্জিপাড়ায় ঢোকে। তার আগে কাছেই একটা ডেরায় বসে আকণ্ঠ চোলাই খেয়েছিল সকলে।

ধৃতেরা পুলিশকে জানিয়েছে, শ্যামল ও সুমন চোলাইয়ের সঙ্গে মাদক-ট্যাবলেট গুঁড়ো করে মিশিয়ে খেয়েছিল। ওই অবস্থাতেই তারা প্রথমে দেবনাথ তালুকদার নামে স্থানীয় এক জনের বাড়িতে হানা দেয়। কিন্তু কাউকে না পেয়ে ফিরে আসার সময় ফাঁকা রাস্তায় সৌরভকে একা মোবাইলে কথা বলতে দেখে তাকেই নিশানা করে শ্যামলেরা। শ্যামলই প্রথমে সৌরভের দিকে তেড়ে যায়। বলে, ‘‘মারধরের ঘটনায় তুইও ছিলি।’’ তার পরেই সৌরভের পিঠে রিভলভার ঠেকিয়ে তাকে টেনেহিঁচড়ে রেললাইনের ধারে একটি আমবাগানে নিয়ে যাওয়া হয়।

কেন ওই রাতে ব্যানার্জিপাড়ায় হানা দিয়েছিল শ্যামলেরা? বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, এলাকায় একটা কালভার্টে বসে মদ খেত শ্যামল ও তার দলবল। যাতে তাদের কেউ চিনতে না পারে তাই রাস্তার বাতি ভেঙে ফেলত তারা। দিন পনেরো আগে তার প্রতিবাদ করেছিলেন পাড়ার লোকজন। শ্যামলদের ধরে পেটানোও হয়েছিল। পুলিশ জেনেছে, সৌরভও ছিল সেই প্রতিবাদীদের দলে। পুলিশের একাংশের অনুমান, সেই ঘটনার জের টেনে ব্যানার্জিপাড়ার বাসিন্দাদের ভয় দেখাতেই শুক্রবার রাতে দলবল নিয়ে এলাকায় ঢুকেছিল শ্যামল। খুন করার ছক তাদের ছিল না। একা রাস্তায় হাতের কাছে পেয়ে নেশার ঘোরেই সৌরভকে তুলে নিয়ে যায় দুষ্কৃতীরা।

আবার পুলিশ কর্তাদেরই অন্য একটি অংশ বলছেন, মনের মধ্যে প্রবল প্রতিহিংসা না থাকলে এ ভাবে খুন করা যায় না। ওই কর্তাদের বক্তব্য, নিয়মিত শরীরচর্চা করা সৌরভের গায়ে ভালই জোর থাকায় প্রাথমিক ভাবে বেশ যুঝতে হয়েছিল দুষ্কৃতীদের। পরে শ্যামলের নির্দেশে জনা দশেক ছেলে সর্বশক্তি দিয়ে ওই যুবককে কাবু করে ফেলে।

পুলিশ বলছে, জেরায় তাপস জানিয়েছে, এলোপাথাড়ি লাথি-ঘুষি ও পরে রিভলভারের বাঁট দিয়ে মারতে মারতে শ্যামলেরা যখন সৌরভকে আধমরা করে ফেলেছে, তখন তাকে এক বার বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল সে। সৌরভকে মাটি থেকে তুলে পিছনে লাথি মেরে বলেছিল, ‘ভাগ শালা, পালা।’ পুলিশকে তাপস বলেছে, তার কথা শুনে সৌরভ দৌড়তে শুরু করলেও বেশি দূর এগোতে পারেনি। আহত শরীরে হাঁফাতে হাঁফাতে কোনওমতে হাঁটতে থাকে সে। তাতেই শ্যামলের মাথায় খুন চেপে যায়।

পুলিশ সূত্রের খবর, তাপসেরা জেরায় জানিয়েছে শ্যামল বলে, “শালার (সৌরভ) এত সাহস, শ্যামলের হাত থেকে বেঁচে গিয়েও হেঁটে-হেঁটে যাচ্ছে? দৌড়চ্ছে না?’’ শ্যামল ছেলেদের বলে, “ধরে নিয়ে আয় ওকে (সৌরভ)।” সেই শুনে শ্যামলের দলবল ফের ধরে আনে সৌরভকে। ধৃতেরা পুলিশকে জানিয়েছে, এর পরে ক্লান্ত, ঝিমোনো সৌরভকে মাটিতে ফেলে তার গায়ের কালো টি শার্ট গলায় পেঁচিয়ে দু’পাশ দিয়ে টানতে শুরু করে শ্যামল ও উত্তম। তখন সৌরভের আর জ্ঞান ছিল না। অচেতন সৌরভকে তার পরেই চ্যাংদোলা করে রেললাইনের পাশে নিয়ে যায় তারা।

এতেও অবশ্য রেহাই মেলেনি। পুলিশ বলছে, অসাড় শরীরটার উপরে শ্যামলের দলবল ভারী পাথর দিয়ে আঘাত করতে শুরু করে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপও মারে। মিনিট দশেক এ ভাবে চলার পরে সকলে মিলে দেহটা রেললাইনের উপরে ফেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ধৃতদের জেরা করে পুলিশ জেনেছে, রক্তাক্ত দেহের পাশে বসে ফের এক দফা মদ খায় শ্যামলেরা। তার পরে দূরে ট্রেনের আলো দেখতে পেয়ে রেললাইনের উপরে ছুড়ে ফেলে দেয় নিথর সৌরভকে।

তদন্তকারীদের অনুমান, সৌরভকে রেললাইনে আড়াআড়ি ভাবে শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল। সে কারণেই ট্রেনের চাকায় ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে দেহের নানা অংশ। রেল পুলিশের কথায়, রেললাইনের আশেপাশে ন’ফুটের মধ্যে সৌরভের দু’টো পা, একটি হাত, মাথা ও বুক থেকে ঊরু পর্যন্ত দেহের মোট ছ’টি অংশ উদ্ধার করা হয়। বাঁ-হাতের অংশ পাওয়া যায়নি। মাথার খুলির একটি অংশও মেলেনি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement