তখন সুদিন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সৃঞ্জয় বসু।
সর্বোচ্চ আদালতে সারদা মামলার ললাটলিখন যেন আগেই পড়তে পেরেছিলেন রাজ্যের শীর্ষ আমলারা!
সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তে আদালতের নজরদারি চেয়ে করা রাজ্যের আবেদন বৃহস্পতিবার খারিজ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। নবান্নের খবর, মামলার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে এ দিন সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিরা যে সব প্রশ্ন তুলেছেন, তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে মামলার আগেই সতর্ক করেছিলেন রাজ্যের একাধিক আমলা। তাঁদের বক্তব্য ছিল, কীসের ভিত্তিতে সরকার আদালতে যাচ্ছে, সরকার আদৌ সুপ্রিম কোর্টে এমন আবেদন জানাতে পারে কি না এ সব বিষয় আগে স্পষ্ট হওয়া দরকার। তাঁদের যুক্তি ছিল, অতীতে সর্বোচ্চ আদালতে সারদা তদন্তের বিরোধিতা করেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। এখন যদি তারাই আদালতের নজরদারিতে তদন্ত চেয়ে আবেদন করে, তা হলে তা হবে পরস্পরবিরোধী।
এ দিন আদালতের রায় জানার পরে প্রশাসনের অনেকেরই মত, একাধিক শীর্ষ আমলার নিষেধ অগ্রাহ্য করে স্রেফ রাজনৈতিক তাগিদ থেকে মামলা করেই মুখ পুড়েছে মমতার সরকারের। যদিও আদালতের রায় নিয়ে এ দিন প্রকাশ্যে কোনও প্রতিক্রিয়া জানাতে অস্বীকার করেন রাজ্যের আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য।
সারদা কেলেঙ্কারিতে শাসক দলের একের পর এক নেতা-মন্ত্রীর নাম জড়িয়ে যাওয়ায় কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে সিবিআই-কে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করার অভিযোগ তোলে তৃণমূল। কিন্তু শুধু দল নয়, মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য সরকারকেও এই অভিযোগে সামিল করতে চাওয়ায় বেঁকে বসেন ওই আমলারা। তাঁদের বক্তব্য ছিল, যদি রাজনৈতিক কারণে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে সিবিআই-কে ব্যবহার করার অভিযোগ আনতে হয়, তা হলে দলীয় স্তরে তা করা যেতেই পারে। কিন্তু এর সঙ্গে সরকারকে জড়ানো ঠিক হবে না। নবান্নের খবর, মুখ্যমন্ত্রী এই যুক্তি পুরোপুরি মানেননি। উল্টে আইনমন্ত্রীকে দিয়ে সর্বোচ্চ আদালতে আবেদন করার প্রস্তুতি নিয়েছেন।
কী রকম?
আদালতে যাওয়ার আগে আইনমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে হলফনামার যে খসড়া তৈরি হয়েছিল, তা নিয়ম মেনে মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র এবং স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে অনুমোদন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু সূত্রের খবর, তাঁরা দু’জনেই কার্যত বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। নবান্নের এক কর্তা জানান, হলফনামা দাখিলের আগে স্বরাষ্ট্র দফতরের এক যুগ্মসচিব আগের দিনই দিল্লি পৌঁছে যান। রাজ্যের হয়ে আইনজীবী কপিল সিব্বল, সরকারি আইনজীবী কবীর বসু এবং আইনমন্ত্রী মিলিত ভাবে একটি খসড়া তৈরি করে সেটি ই-মেল করে পাঠান স্বরাষ্ট্রসচিবের কাছে। তিনি ই-মেলটি পড়ে চমকে ওঠেন। কারণ, খসড়ার প্রতিটি ছত্রে ছিল রাজ্যের বিরুদ্ধে বিজেপি-র রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথা। লেখা ছিল, সিবিআই-কে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছেন প্রধানমন্ত্রী। বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ ‘ভাগ মদন ভাগ’ বলার পরেই রাজ্যের মন্ত্রী মদন মিত্রকে সিবিআই গ্রেফতার করেছে বলেও ওই খসড়ায় লেখা হয়। খসড়ার বিষয়বস্তু মুখ্যসচিবকে জানান স্বরাষ্ট্রসচিব। তা দেখে মুখ্যসচিবও অনুমোদন দিতে অস্বীকার করেন।
তখন সুদিন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে লকেট চট্টোপাধ্যায়।
খসড়া হলফনামা দেখে প্রশাসনের একাংশ প্রশ্ন তুলেছিল, সারদা তদন্তের সঙ্গে সরকারের যোগসূত্র কী, সুপ্রিম কোর্ট এই প্রশ্ন তুললে তার কী জবাব দেবে রাজ্য? একই ভাবে সরকার কেন আগ বাড়িয়ে সিবিআই তদন্তের উপরে সুপ্রিম কোর্টের নজরদারি চাইছে বা সিবিআই তদন্তে সরকার কী ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এ সব প্রশ্নেরই বা জবাব কী হবে? আইন দফতরের এক দল অফিসার প্রশাসনের শীর্ষমহলকে জানান, সিবিআইয়ের তদন্ত যে পক্ষপাতদুষ্ট, এমন কোনও প্রমাণ হাতে না নিয়ে আদালতে যাওয়া ঠিক হবে না। এর পাল্টা যুক্তি হিসেবে বলা হয়, সাক্ষ্য দেওয়ার নামে সিবিআই যে এক মন্ত্রীকে গ্রেফতার করেছে, সর্বোচ্চ আদালতে সেই উদাহরণ তুলে ধরা হবে। কিন্তু সিবিআইয়ের কেস ডায়েরির ভিত্তিতে ওই মন্ত্রীকে যে হেতু জামিন দেয়নি নিম্ন আদালত, তাই এই নিয়ে কতটা এগোনো যাবে, সেই প্রশ্নও তোলেন সরকারি কর্তারা।
নবান্নের খবর, এমন নানাবিধ বক্তব্য ও প্রশ্ন ওঠায় স্বরাষ্ট্রসচিব ফোন করেন আইনমন্ত্রীকে। সে সময় তাঁদের মধ্যে তুমুল কথা কাটাকাটিও হয়। আইনমন্ত্রী স্বরাষ্ট্রসচিবকে বলেন, মুখ্যমন্ত্রী যেখানে চাইছেন, সেখানে আপনি আপত্তি করছেন কেন? স্বরাষ্ট্রসচিব পাল্টা তাঁকে বলেন, তা হলে মুখ্যমন্ত্রীই হলফনামা মঞ্জুর করুন। পরে মুখ্যসচিব এবং স্বরাষ্ট্রসচিব হলফনামা অনুমোদন করার ব্যাপারে তাঁদের আপত্তির কথা জানিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রীকেও।
সরকারের এক মুখপাত্র জানান, ওঁদের মুখে আপত্তির কথা শুনে বেজায় চটে যান মমতা। আইনমন্ত্রীকে কপিল সিব্বলের সঙ্গে কথা বলার নির্দেশ দেন। শেষে পরিস্থিতি ঘোরালো হচ্ছে বুঝে মুখ্যমন্ত্রী ফের ওই দুই শীর্ষকর্তাকে ডেকে পাঠিয়ে সমাধান সূত্র বের করতে বলেন। মুখ্যমন্ত্রীর মখরক্ষায় তখন তাঁরা জানান, একান্ত মামলা করতে হলে আলাদা হলফনামা দিক সরকার। তাতে বলা হোক: এক, সিবিআই তদন্তে সুপ্রিম কোর্টের নজরদারি দরকার। দুই, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সিবিআই সংক্রান্ত খবর নিয়ন্ত্রণ করা হোক এবং তিন, সারদার বিরুদ্ধে সিট যে আটটি মামলা দায়ের করেছিল, সিবিআই সেগুলি হাতে নিক। এর বাইরে যা রাজনৈতিক বক্তব্য আছে, তা নিয়ে আলাদা আবেদন করুক দল। শেষ পর্যন্ত এই রফাসূত্র মেনে নেন মুখ্যমন্ত্রী।
কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হল না!
—ফাইল চিত্র।