শাহজাহান শেখ। —ফাইল চিত্র।
সন্দেশখালিতে ইডির অভিযানকে কেন্দ্র করে ধুন্ধুমারকাণ্ড। তা নিয়েই তোলপাড় রাজ্য রাজনীতি। রেশন দুর্নীতি মামলার তদন্তে শাহজাহান শেখের বাড়িতে তল্লাশি চালাতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা! যা নিয়ে শাসক-বিরোধী শিবিরের টানাপড়েন চলছেই। সেই ঘটনার পর ৩৬ ঘণ্টা কেটে গেলেও এখনও তৃণমূল নেতা শাহজাহানের নাগাল পাওয়া যায়নি। ইডির একটি সূত্রের দাবি, ঘটনার সময় বাড়িতেই ছিলেন শাহজাহান। কিন্তু তার পর তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। তিনি বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়ে থাকতে পারেন, এমনটা অনুমান করে ইতিমধ্যেই আইবি (ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো) এবং বিএসএফ (সীমান্ত রক্ষী বাহিনী)-এর সাহায্য চাওয়া হয়েছে বলে খবর ইডি সূত্রে। এ সবের মধ্যে প্রকাশ্যে আসা একটি অডিয়োবার্তা নিয়ে জল্পনা তৈরি হয়েছে। জল্পনার কারণ, অডিয়োবার্তায় এক ব্যক্তি নিজেকে ‘শেখ শাহজাহান’ বলে পরিচয় দিয়েছেন! বলেছেন, ‘‘ইডি-সিবিআইকে নিয়ে ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ বুঝতে পারছে, পুরোটাই চক্রান্ত।’’ অডিয়োবার্তার ওই কণ্ঠস্বর শাহজাহানেরই কি না, আনন্দবাজার অনলাইন অবশ্য তা যাচাই করেনি। সেটি কবে রেকর্ড করা হয়েছে, তার কোনও উল্লেখও নেই অডিয়োবার্তায়।
ইডি সূত্রে খবর, আইবি ও বিএসএফকে সতর্ক থাকতে বলার পাশাপাশি শাহজাহানের বিরুদ্ধে জারি হয়েছে লুক আউট নোটিস। ‘এয়ারপোর্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়া’কে বিষয়টি জানিয়ে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে সজাগ থাকার বার্তা দেওয়া হয়েছে। নিখোঁজ তৃণমূল নেতাকে খুঁজে বার করতে কেন্দ্রীয় সংস্থা যখন নানা পদক্ষেপ করে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে ওই অডিয়োবার্তা প্রকাশ্যে এসেছে। যেখানে নিজেকে শাহজাহান বলে পরিচয় দেওয়া ওই ব্যক্তিকে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলতে শোনা গেল, ‘‘আমি কোনও অন্যায়, কোনও অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নই। কেউ যদি প্রমাণ করতে পারে যে আমি কোনও রকম অপরাধে যুক্ত, তা হলে আমি আমার নিজের মুন্ডুটা নিজে কেটে দেব।’’ যা ঘটছে, সবই ষড়যন্ত্র বলেও দাবি করা হয়েছে ওই অডিয়োবার্তায়। ওই কণ্ঠে শোনা যায়, ‘‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমার মতো হাজার হাজার শেখ শাহজাহান আছে। আর তোমরা তৃণমূলের সৈনিক। যে ভাবে মানবিক মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমার, আপনার পরিবারের জন্য করেছেন, তা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। আমরা সবাই মানুষ। মৃত্যু যে সত্য, একে অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই। সকলকে করজোড়ে অনুরোধ করছি, মনুষ্যত্ব বিসর্জন দেবেন না। মৃত্যু হবেই। কেউ আগে আর কেউ পরে (মারা যাবেন)। ইডি-সিবিআই যেটা করছে, সেটা যে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, সবাই বুঝতে পারছেন।’’
এ নিয়ে জোর রাজনৈতিক তরজা শুরু হয়েছে। বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘শাহজাহান যাঁর অনুগামী, তিনি বলছেন ফাঁসির মঞ্চে ঝুলবেন। শাহজাহান বলছেন, নিজের মাথা নিজে কাটবেন। এমন ভাবে কথা বলছেন, ভাবখানা যেন, ‘আমি সুভাষ বলছি।’ এদের সম্পর্কে কিছু বলতেও রুচিতে বাধে।’’ এ ব্যাপারে তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘এই বিষয়টি এক তরফা হচ্ছে। উল্টো দিকের বক্তব্যও শোনা উচিত। তবে কে অন্তরাল থেকে বার্তা দিল বা প্রকাশ্যে বার্তা দিল, তা নিয়ে দলের কিছু বলার নেই।’’ প্রসঙ্গত, শনিবার কুণাল দাবি করেছিলেন, শাহজাহানকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুঁজে বার করতে রাজ্য প্রশাসনের সাহায্য চেয়েছে ইডি। যদিও কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ওই দাবি অস্বীকার করেছে।
শুক্রবার সন্দেশখালিতে শাহজাহানের বাড়িতে তল্লাশি অভিযানে গিয়েছিল ইডি। সেখানে হামলার মুখে পড়েন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকেরা। ইডি সূত্রে অভিযোগ, অনেক ক্ষণ ধরে ডাকাডাকির পরেও সাড়াশব্দ না মেলায় বাড়ির দরজা ভাঙার চেষ্টা করেন তদন্তকারীরা। ঠিক সেই সময়েই প্রায় ৮০০-১০০০ সশস্ত্র গ্রামবাসী তাঁদের ঘিরে ধরেন। এঁদের কারও হাতে লাঠি, কারও হাতে পাথর, কারও হাতে ইট ছিল। সে সব নিয়ে ঘটনাস্থলেই ইডির উপর চড়াও হন তাঁরা। জনরোষের মুখে পড়তে হয় ইডি আধিকারিকদের। ইট-পাটকেল, লাঠিসোঁটা নিয়ে তাঁদের দিকে তেড়ে আসেন স্থানীয় এবং তৃণমূল নেতা শাহজাহানের অনুগামীরা। প্রাণ বাঁচাতে ঘটনাস্থল ছেড়ে বেরিয়ে যান ইডি আধিকারিকেরা। তবে উন্মত্ত জনতার মারের চোটে তিন জন ইডি অফিসার আহত হন। তার মধ্যে এক জন উচ্চপদস্থ কর্তার মাথা ফেটেছে। মাথায় পাঁচ-ছ’টি সেলাই পড়েছে। তাঁরা তিন জনেই সল্টলেকের এক বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ওই ঘটনায় শনিবার ইডিরই বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হয়েছে। এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
জেলা পুলিশ সূত্রে খবর, সন্দেশখালির ঘটনায় মোট তিনটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। তার মধ্যে একটি ইডির বিরুদ্ধে। শাহজাহানের বাড়ির এক কর্মচারীর অভিযোগের ভিত্তিতে ন্যাজাট থানায় এফআইআই দায়ের হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, কোনও বৈধ তল্লাশি পরোয়ানা (সার্চ ওয়ারেন্ট) ছাড়া তৃণমূল নেতার বাড়িতে এসে তালা ভেঙেছেন ইডি আধিকারিকেরা। হেনস্থার অভিযোগও তোলা হয়েছে। বাকি যে দু’টি এফআইআর হয়েছে, তার একটি করেছে ইডি। ঘটনাস্থলের বেশ কিছু ভিডিয়ো পুলিশকে দিয়েছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। পুলিশও স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে একটি অভিযোগ দায়ের করেছে। কিন্তু কোন যুক্তিতে ইডির বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করল পুলিশ, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন বিরোধীরা। বিজেপি নেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর বলেন, “পুলিশ ইডির বিরুদ্ধে এফআইআর করে কী করে? ইডির অধিকার রয়েছে, তারা যদি জানতে পারে কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার রয়েছে ইডির। দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত যে কাউকেই ইডি গ্রেফতার করতে পারে। পুলিশ তার নিজের যোগ্যতা ভুলে যাচ্ছে, দলদাস হয়ে যাচ্ছে। এমনটা চলতে থাকলে পুলিশের বিরুদ্ধে ভয়ানক অবস্থা হতে পারে।” পাল্টা তৃণমূলের শান্তনু সেন বলেন, ‘‘আইনের ঊর্ধ্বে তো কেউ নন। ইডির অফিসারেরা যদি কেন্দ্রীয় বাহিনী পরিবৃত হয়ে সাধারণ মানুষকে উত্যক্ত করেন, তা হলে তাঁদেরও অধিকার আছে এফআইআর করার। এই অধিকার সংবিধান সকলকে দিয়েছে।’’
শাহজাহানের বালু-যোগ
সন্দেশখালিকাণ্ড নিয়ে তরজার মধ্যে শাহজাহানের সঙ্গে রেশন দুর্নীতি মামলায় ধৃত জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের ‘ঘনিষ্ঠতা’ জেলার আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। প্রকাশ্যে কিছু না-বললেও ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তৃণমূলের বসিরহাট সাংগঠনিক জেলার এক প্রবীণ নেতা বলছেন, ‘‘বালুদার (জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক) জন্যই ওঁর এত বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল। বসিরহাট কেন, জেলার অনেক বড় বড় নেতা যখন মন্ত্রী বালুদার ঘরে ঢোকার সাহস করতেন না, তখন, শাহজাহানের জন্য বালুদার ঘরের দরজা ছিল সব সময় খোলা। কোনও বাধা ছাড়াই ও ঢুকে যেত বালুদার ঘরে। দাদা হাসি মুখে মেনেও নিত এ সব।’’ প্রথম জীবনে ট্রেকারের হেল্পার থেকে ভেড়ির মালিকানা পাওয়া শাহজাহান একটা সময়ে সিপিএমের ‘অ্যাকশন স্কোয়াড’-এর সক্রিয় সদস্য ছিল বলেই অভিযোগ বসিরহাটের পুরনো তৃণমূল নেতৃত্বের। তাই তাঁর অনুগামীদের হাতে ইডি আধিকারিকদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় আশ্চর্য নন কেউই। তাঁর ‘ঔদ্ধত্যে’র পিছনেও বালুর রাজনৈতিক প্রশ্রয়কেই দায়ী করছে দলের একাংশ। একটা সময়ে হাসনাবাদের সিপিএম বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী গৌতম দেবের ‘সুনজরে’ থাকা শাহজাহানকে তৃণমূলে নিয়ে আসেন জ্যোতিপ্রিয়ই। শাহজাহানের রকেটগতিতে উত্থানের পিছনেও তাঁর প্রশ্রয়কেই দায়ী করছেন দলের একাংশ। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পর তৃণমূলের বালুর ডানা ছাঁটা শুরু হয়। খাদ্য দফতরের বদলে পান বন। সাংগঠনিক ভাবেও তাঁকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সেই সময়েও সল্টলেকের অরণ্য ভবনে বালুর ঘরের দ্বারও ছিল শাহজাহানের জন্য অবারিত। এমনকি, বিধানসভা অধিবেশন চললে প্রায়ই জ্যোতিপ্রিয়ের ঘরে দেখা মিলত তাঁর। গত পঞ্চায়েত ভোটের সময়েও বালুর তদারকিতেই সন্দেশখালি থেকে জেলা পরিষদের টিকিট পান শাহজাহান। জয়ী হয়ে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের মৎস্য দফতরের কর্মাধ্যক্ষও করা হয় তাঁকে। সে ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা ছিল বালুর। গত অক্টোবরে বালু ইডির হাতে গ্রেফতার হলেও, সন্দেশখালিতে শাহজাহানের প্রভাব কমেনি। স্থানীয়দের একাংশের দাবি, সন্দেশখালিতে সেই প্রভাবেরই প্রতিফলন দেখা দিয়েছে শুক্রবার।
শাহজাহানকে নিয়ে শতাব্দী
বীরভূমের সাংসদ শতাব্দী রায় শনিবার রামপুরহাটের বনহাট গ্রাম পঞ্চায়েতে একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। সেখানে সন্দেশখালির ঘটনা নিয়ে শতাব্দীকে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকেরা। জবাবে তৃণমূল সাংসদ বলেন, ‘‘এই রকমের অ্যাটাক সমর্থনযোগ্য নয়। দল বলেনি এটা করতে। দল এই কাজ সমর্থনও করে না। কেউ যদি ব্যক্তিগত ভাবে এটা করে, সেটা তার নিজের দায়িত্বে। এতে দলের কোনও দায় নেই।’’ পাশাপাশি শতাব্দী এ-ও মনে করছেন যে, এই ঘটনায় তৃণমূলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘অলরেডি বিরোধীরা বলতে শুরু করেছে। ক্ষতি তো হচ্ছেই। জার্নালিস্টরা মাইক হাতে প্রশ্ন করার সুযোগ পাচ্ছেন।’’