দু’বছর আগে আমতার মুক্তিরচক গ্রামে এক মহিলা এবং তাঁর জেঠশাশুড়িকে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল এলাকার দুই তৃণমূল নেতা-সহ ১০ জনের বিরুদ্ধে। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয় ইনিংস শুরুর পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বিরোধীদের মর্যাদা দেওয়ার বার্তা দিচ্ছেন, তখন বাম সমর্থক ওই নির্যাতিতাদের পরিবারকে একঘরে করার দাবি তুললেন তাঁর দলেরই স্থানীয় নেতারা!
রবিবার রাতে সালিশি সভায় মুক্তিরচকের তৃণমূল নেতারা ওই দাবি জানান সিপিএম সমর্থকদের কাছে। মামলার শুনানি যখন শেষ পর্যায়ে, তখন শাসক দলের এমন দাবি পত্রপাঠ নাকচ করে সিপিএম জানিয়েছে, ওই পরিবারের পাশেই থাকবে।
এতদিন পরে কেন ওই দাবি?
গ্রামের বেশিরভাগ বাসিন্দাই সিপিএম কর্মী-সমর্থক। তবে এলাকাটি উলুবেড়িয়া উত্তর বিধানসভার অধীন। এই কেন্দ্রে অবশ্য তৃণমূল ফের জিতেছে। তার পর থেকেই তৃণমূল গ্রামে ‘বহিরাগত’দের ডেকে এনে তাণ্ডব করছে বলে সিপিএমের অভিযোগ। তাতে অতিষ্ঠ হয়ে তাঁদের অনেকেই তৃণমূলে যোগ দিতে চেয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন সিপিএম নেতাকর্মীরা। সেই দলে নির্যাতিতাদের পরিবারও আছে। সিপিএমের দাবি, নির্যাতিতাদের দলে নিতে চায়নি তৃণমূল। আর তাদের বাকি নেতাকর্মীদের দলে নিতে ১২ দফা শর্ত চাপান তৃণমূল নেতারা। তার মধ্যে রয়েছে ধোপা-নাপিত বন্ধ করে ওই পরিবারকে একঘরে করার শর্তও।
এতে অন্যায় কিছু দেখছেন না স্থানীয় তৃণমূল নেতা তাপস গায়েন। তিনি বলেন, ‘‘অভিযুক্তেরা তো আদালতের নির্দেশে গ্রামের বাইরে আছে। নির্যাতিতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে যদি কেউ দলে আসতে চায়, সেটা কী করে সম্ভব? ওই দশ জনের পরিবার কী ভাববে? দলে আসতে হলে নির্যাতিতার পরিবারের সঙ্গ ছাড়তে হবে। এটাই সাফ কথা।’’
এলাকার তৃণমূল বিধায়ক নির্মল মাজি অবশ্য এমন শর্ত-আরোপকে দলবিরোধী কাজ বলেই মনে করছেন। তিনি বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নে সামিল হতে ওই সিপিএম কর্মীরা তৃণমূলে আসতে চান। যদি কেউ শর্ত চাপায়, দল ব্যবস্থা নেবে।’’ তাপসবাবুর ব্যাখ্যা, ওই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে গ্রামে অশান্তি হতে পারে। তাই ওই শর্ত। এতে দলবিরোধী কাজের কিছু নেই।
২০১৪-র ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে ওই গণধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত দুই তৃণমূল নেতা বরুণ মাখাল ও রঞ্জিত মণ্ডল-সহ ১০ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে। গ্রামে না ঢোকার শর্তেই ধৃতেরা হাইকোর্ট থেকে জামিন পায়। মামলাটির শুনানি চলছে আমতা আদালতে। সিপিএমের অভিযোগ, ভোটের ফল প্রকাশের পর থেকেই তৃণমূল বাম নেতা-কর্মীদের মামলাটি তুলতে চাপ দেয়। এমনকী ধৃতেরা যাতে গ্রামে ঢুকতে পারে হাইকোর্টে সেই আবেদন এবং তার যাবতীয় খরচ সিপিএমকেই করতে হবে বলেও তৃণমূল দাবি তোলে। কিন্তু সিপিএম নেতৃত্ব তা মানেননি।
সিপিএম নেতা বিবেকানন্দ গায়েন বলেন, ‘‘আমরা তৃণমূল নেতাদের জানাই, মামলা তোলা যাবে না। গ্রামে শান্তি ফেরাতে আমরা তৃণমূলে যেতে রাজি। তখন ওরা আমাদের পার্টি অফিস বন্ধ রাখা, ওই পরিবারকে একঘরে করা-সহ ১২টি শর্ত দেয়। কিন্তু সালিশিতে জানিয়ে দিয়েছি, ওই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ আমরা রাখবই।’’ ঘটনার পর থেকেই নির্যাতিতাদের বাড়ির সামনে ২৪ ঘণ্টা পুলিশ পাহারা রয়েছে। দলীয় নেতারা পাশে থাকায় আশ্বস্ত বোধ করছেন নির্যাতিতারা। সোমবার তাঁরা বলেন, ‘‘আমাদের একঘরে করার যে চক্রান্ত চলছিল, তা গ্রামবাসীরা ঠেকিয়ে দিয়েছেন। আমরা সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে চাই।’’
তৃণমূলের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় গ্রামবাসীদের অভিনন্দন জানিয়েছেন জেলা সিপিএম সম্পাদক বিপ্লব মজুমদারও। তিনি বলেন, ‘‘ওখানে তৃণমূল দ্বিচারিতা করছে। আগে ওরা মুখে বলেছে, গণধর্ষণে তাদের কেউ জড়িত নয়। এখন আবার অভিযুক্তদের পক্ষ নিয়ে নির্যাতিতাদের একঘরে করার চেষ্টা করল।’’
গ্রামবাসীরাও জানিয়েছেন, তাঁরা ওই পরিবারের পাশে রয়েছেন।