মুখ্যমন্ত্রীর আঁকা ছবি তিনি কেনেননি বলে সংবাদমাধ্যমে দাবি করেছিলেন রোজভ্যালি কর্তা গৌতম কুণ্ডু। অথচ সিবিআইয়ের কাছে দাখিল করা হিসেবে তৃণমূল কিন্তু জানিয়েছে, গৌতম ৫০ লক্ষ টাকা দিয়ে ছবি কিনেছেন। ওই টাকায় ক’টি ছবি তিনি কিনেছেন, তা অবশ্য স্পষ্ট নয় ওই হিসেবে।
সারদা-সহ অন্য অর্থলগ্নি সংস্থার তদন্তে নেমে সিবিআই জানতে পারে, অভিযুক্তদের কয়েক জন টাকা দিয়েছেন শাসক দলকে। সেই টাকা দেওয়া হয়েছে মমতার নিজের আঁকা ছবি কেনাবেচার মাধ্যমে। এই সূত্রে সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে রোজভ্যালি কর্তা গৌতম কুন্ডুর নামও জড়িয়েছিল। ধৃত সাংসদ কুণাল ঘোষ সিবিআইকে বলেছিলেন, গৌতমবাবু এক কোটি ৮২ লক্ষ টাকার ছবি কেনেন। সিবিআইয়ের দাবি ছিল, তাদের কাছে জেরার মুখে গৌতমবাবু ছবি কেনার কথা স্বীকারও করেছিলেন। সারদা মামলা সামনে আসার আগে পর্যন্ত বেক বাগান এলাকার একটি হোটেলে সেই ছবি টাঙিয়ে রাখা ছিল দীর্ঘ দিন। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে এ সব কথা স্বীকার করেননি গৌতমবাবু। গত বছর ১৭ অক্টোবর এবিপি আনন্দে গৌতমবাবুকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘‘আপনি কত টাকায় মুখ্যমন্ত্রীর আঁকা ছবি কিনেছিলেন?’’ উত্তরে গৌতমবাবু বলেছিলেন, ‘‘এই সব অভিযোগ মিথ্যা। কোনও ভিত্তি নেই। ওদের প্রমাণ করতে দিন।’’ প্রশ্ন আসে, ‘‘আপনি ছবি কিনেছিলেন কি না?’’ গৌতমবাবু বলেন, ‘‘না। সরাসরি, না। আমি সরাসরি কথা বলতে ভালবাসি।’’
কিন্তু সম্প্রতি খোদ তৃণমূলের তরফে সিবিআইকে মমতার ছবি বিক্রির যে হিসেব দাখিল করা হয়েছে, তাতে ক্রেতার তালিকায় গৌতমবাবুর নাম রয়েছে। তবে এক কোটি ৮২ লক্ষ নয়, তৃণমূলের হিসেবে গৌতমবাবু ছবির দাম বাবদ ৫০ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন। সেই হিসেব এসে পৌঁছেছে এবিপি আনন্দ-র হাতে। এ বছরের মার্চ মাসে তৃণমূলকে ছবির হিসেব চেয়ে চিঠি দিয়েছিল সিবিআই। তারই প্রেক্ষিতে তৃণমূলের নেতা তাপস রায় গিয়ে সিবিআইয়ের কাছে একটি হিসেব দিয়ে আসেন। সেই হিসেবেই উল্লেখ রয়েছে গৌতমবাবুর ছবি কেনার প্রসঙ্গ। জানা গিয়েছে, গৌতম কুন্ডুর তরফে ২০১১ সালের ১১ এপ্রিল প্রথম দফায় মমতার আঁকা ছবি কেনা হয় ২০ লক্ষ টাকা দিয়ে। এর পরে ২০১৩ সালে আরও এক দফা ছবি কেনেন রোজভ্যালি কর্তা। সে বার তিনি দিয়েছিলেন ৩০ লক্ষ টাকা।
মুখ্যমন্ত্রীর আঁকার অভ্যাস বহুদিনের। সম্প্রতি তিনি একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘‘তিনটে আঁচড় কাটব। দশ লক্ষ টাকায় আমার ছবি বিক্রি হবে।’’ এই দরদাম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সিবিআইয়ের অফিসারেরা। মমতার ঘনিষ্ঠ চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্নকে জেরার সময়েও তদন্তকারী অফিসারেরা জানতে চেয়েছিলেন, মমতার মতো একজন শিল্পীর আঁকা ছবি সর্বোচ্চ কত টাকা দামে বিক্রি হতে পারে? সে প্রসঙ্গে উঠে আসে বিশ্ববন্দিত দুই চিত্রশিল্পী ভ্যান গঘ এবং দা-ভিঞ্চির প্রসঙ্গও। কিন্তু এখন তৃণমূলের কাছ থেকে মমতার ছবি বিক্রির হিসেব পেয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসেছেন তদন্তকারীরা। দেখা গিয়েছে, ব্যক্তি ও সংস্থা মিলিয়ে ৫০ জনেরও বেশি বিভিন্ন সময়ে মমতার ছবি কিনেছেন। তার মধ্যে যে সংস্থার পাশে সবচেয়ে বেশি অঙ্কের টাকা লেখা সেটিই রোজভ্যালি, ৩০ লক্ষ টাকা।
তৃণমূলের দেওয়া এই হিসেব অনুযায়ী ২০১১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সব মিলিয়ে মমতার আঁকা ছবি বিক্রি হয়েছে মোট ৬ কোটি ৪৭ লক্ষ টাকায়। এই হিসেব ৭ এপ্রিল আনন্দবাজার পত্রিকার পাতাতেও প্রকাশিত হয়েছিল। সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে, ছবির টাকা সবই এসেছে হয় চেক, নয়তো ডিমান্ড ড্রাফ্ট-এ। নগদ টাকায় লেনদেনের কোনও হিসেব এখানে নেই। তবে বেশ কিছু নামী ব্যক্তি ও সংস্থা ছাড়াও ছবির ক্রেতার তালিকায় বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাঙ্কের নাম রয়েছে। তদন্তকারী অফিসারদের মতে, কোনও ভাবেই ব্যাঙ্ক এই সব ছবি কিনতে পারে না। এ ক্ষেত্রে আসল ক্রেতার নাম আড়াল করা হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। তদন্তকারীদের ধারণা, নিজেকে আড়াল করে যাঁরা ওই ছবি কিনেছিলেন, তাঁরা সংশ্লিষ্ট ওই ব্যাঙ্কের ডিমান্ড ড্রাফ্ট মারফত টাকা দিয়েছিলেন। মধ্য কলকাতার একটি ব্যাঙ্কের শাখা থেকে ৯ লক্ষ টাকার চারটি এবং ৭ লক্ষ টাকার দু’টি ড্রাফ্ট কাটা হয়েছিল।