চিলাপাতার জঙ্গলে খড়্গ কাটা গন্ডারের দেহ। ফাইল চিত্র
নকশাগুলোই যেন পাল্টে গিয়েছে। তা-ও এক বা দু’দশকের ব্যবধানে।
এখন সোনাপুর থেকে মথুরা চা বাগান হয়ে চিলাপাতার জঙ্গলের পথে এগোতে নজরে পড়বে একের পর রিসর্ট। একই দৃশ্য দেখা যায় জাতীয় অভয়ারণ্য গরুমারা লাগোয়া মূর্তি নদীর ধারেও। জলদাপাড়ায় তো জঙ্গলের মধ্যেই গড়ে উঠেছে সরকারি বনবাংলো, এবং সেটা বহু বছর আগেই। হলং বনবাংলো নামে পরিচিত সেই বাংলো পছন্দের জায়গা ছিল প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর। পরিবেশপ্রেমীরা বারবারই বলেন, “প্রকৃতিকে যেন ক্রমশই গিলে খাচ্ছে ইট-কাঠ-পাথরের জঙ্গল।”
তাতে অবশ্য পরিস্থিতি বদলায়নি। এক দিকে যেমন জঙ্গল সঙ্কুচিত হয়েছে, বেড়েছে বাইরের লোকের আনাগোনা, পাশাপাশি চোরাশিকারির হানায় তটস্থ হয়ে রয়েছে বন দফতর।
‘‘এই শীতের সময়টাই সব থেকে ভয়ের,’’ বলছিলেন এক বনকর্মী। নিজের নামধাম প্রকাশ করতে নারাজ তিনি। বললেন, ‘‘গত কয়েক বছর ধরেই দেখুন, কত বন্যপ্রাণীর চামড়া, গন্ডারের খড়্গ ধরা পড়েছে। কত গন্ডারের দেহ মিলেছে যেখানে খড়্গ কেটে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের কোনও হেলদোল আছে?’’
বন দফতরের আধিকারিকদের অনেকেই জানান, চোরাশিকারিদের একটি দল উত্তরবঙ্গ জুড়ে সক্রিয়, যাদের বিস্তার উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে মায়ানমার পর্যন্ত। চলতি বছরের অগস্টে গরুমারার জঙ্গল থেকে একটি বাইসনের দেহ উদ্ধার হয়। ঘটনার তদন্তে নেমে এক অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়। উদ্ধার হয় বাইসনের দাঁত ও মাংস। একই ভাবে গন্ডারের দেহ উদ্ধার হয়েছে বহুবার। সেই গন্ডারগুলির খড়্গ লোপাট ছিল। হরিণ বা বুনো শূকর শিকারের অভিযোগ তো মাঝে মাঝেই আসে। চিলাপাতা লাগোয়া একটি বনবস্তির বাসিন্দারা বলেন, “অনেক দিন ধরেই এমনটা চলে আসছে।”
একটা সময়ে উত্তরবঙ্গের জঙ্গলগুলিতে বাঘের দেখা মিলত। আর এখন? বক্সায় বাঘ আছে কি না, তা নিয়ে দীর্ঘদিন লুকোচুরি চলেছে। শেষে বনবিভাগ মেনে নিয়েছে, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা ঠেকেছে শূন্যে। উত্তরবঙ্গে ছড়িয়ে থাকা বিস্তীর্ণ জঙ্গল এলাকার কোনটিতে জাতীয় পশুর দেখা মিলতে পারে, তা নিয়ে যথেষ্ট ধন্দ রয়েছে বনকর্মীদের মধ্যেই। শুধু বাঘ কমে যাওয়াই নয়, হাতিদের লোকালয়ে আসা বা চিতাবাঘের শিলিগুড়ি শহরে ঢুকে পড়ার মতো ঘটনাকে তুলে ধরে একটাই কথা বলছেন পরিবেশপ্রেমীরা, ‘‘জঙ্গল কমছে। বন্যপ্রাণীদের চলার পথে তৈরি হচ্ছে জনপদ। এবং সে দিকে কোনও দিনই কোনও প্রশাসন বিশেষ নজর দেয়নি।’’ জলদাপাড়া এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘হাতি করিডরে যে ভাবে বসতি হয়েছে, সেখানে ঘরবাড়ি ঘিরে যথেচ্ছ ভাবে বেআইনি বিদ্যুতের তার লাগানো হয়েছে, তার কথা সকলেই জানে। কিন্তু কোনও প্রতিকার হয়েছে কি?’’
বন্যপ্রাণী কমে যাওয়ার পিছনে একটা কারণ যেমন চোরাশিকারিদের আঘাত, অন্য দিকে জঙ্গল কমে যাওয়াও বড় কারণ। ২০১০ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, দার্জিলিঙে বনাঞ্চল রয়েছে ২০ শতাংশ, জলপাইগুড়িতে ১৯ শতাংশ এবং কোচবিহারে ১.২ শতাংশ। অথচ একসময় ওই বনাঞ্চলের পরিমাণ ছিল দ্বিগুণ। চলতি বছরে এই সমীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার ধাক্কায় তা আর হয়ে ওঠেনি।
এই অঞ্চলের বাসিন্দারা বলছেন, উন্নয়নের স্বার্থে কিছু এলাকায় জঙ্গল কেটে পদক্ষেপ করা যেতেই পারে। কিন্তু এই কাজে তো ভারসাম্য রাখতে হবে। আইনের খাতায় রয়েছে, গাছ কাটলে তার থেকে বেশ কয়েক গুণ বেশি গাছ লাগাতে হবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা কতটা মানা হয়? সে দিকে নজরই বা রাখে কে? কোচবিহারের ডিএফও সঞ্জিত সাহা অবশ্য বলেন, “বনবস্তির মানুষদের সঙ্গে নিয়েই একাধিক পদক্ষেপ করা হয়েছে। তাতে আগের থেকে অনেকটাই বদল এসেছে।”
একটি পরিবেশপ্রেমী সংগঠনের সম্পাদক অনিমেষ বসু বলেন, “জঙ্গলে অসংখ্য মানুষ ঢুকছে। শান্তিও বিঘ্নিত।’’ আর একটি গ্রুপের সম্পাদক অরূপ গুহ দাবি করেন, ‘‘১৯৯৩ সালে মূর্তিতে একটি মাত্র বন দফতরের লজ ছিল। সেখানে এখন অসংখ্য রিসর্ট।’’ তিনি বলেন, “পর্যটন বাড়াতেই হবে। সেই সঙ্গে জঙ্গল ও বন্যপ্রাণ রক্ষা করতে হবে। না হলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে।’’
মুখ্য বনপাল (বন্যপ্রাণ, উত্তরবঙ্গ) রাজেন্দ্র জাখর বলেন, ‘‘সব সময় বনাঞ্চল ঘিরে নজরদারি চলে। নির্দিষ্ট কোনও ঘটনা ঘটলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’’